আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর জীবন একার, নারীর জীবন সবার!

0
14

লীনা পারভীন
নারী দিবস আসে নারী দিবস চলেও যায়। প্রতিবার দিবসকে কেন্দ্র করে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে একটি শ্লোগানও ঠিক করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো দিবসকেন্দ্রিক চিন্তা করার মানুষ না হলেও কর্পোরেট মানসিকতার যুগে দিবস ঘোষণা না করলে আবার মানুষের মনোযোগও পাওয়া যায় না। সবকিছুই কর্পোরেট জগতের লোকাচার হয়ে গেছে। এখানে “কর্পোরেট” শব্দটির ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই অর্থই আছে। নির্ভর করছে দেখার বা বোঝার দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
ছোটবেলায় একটা ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম,‘পুষ্প আপনার জন্য ফুটেনা’ অর্থাৎ, ফুলের জন্মই হয়েছে অন্যকে আনন্দ দেবার জন্য। অন্যের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াতেই ফুলের সার্থকতা। আর নারী বিষয়ে জন্মের পর থেকেই যা শিখে এসেছি তার শানে নুজুল করলে দাঁড়ায় নারী আপনার জন্য জন্মায়না। অপরের সেবা, সহযোগিতা আর মনোবাঞ্চনা পূরণেই নারী জন্মের সার্থকতা আসে। এই যে অপরের জন্য নিজেকে মহান করতে শিখানো হলো এই শিক্ষাই নারীদেরকে মূলত একলা করে দিয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশে যদি আগে স্মার্ট চিন্তার মানুষ তৈরি করা না যায় তাহলে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি কেবল ব্যবহারিকই হয়ে থাকবে। প্রযুক্তির এই কল্যাণকে নারীর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে অবশ্যই আলাদা কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। আর এই কাজটি করার দায়িত্ব আমাদের নারী ও শিশু বিষয়ক যতগুলো কর্তৃপক্ষ আছে তাদের
এই মহান হতে গিয়ে নারীরা নিজের ভালোমন্দ, খারাপ লাগা, ভালোলাগা কোন কিছুকেই আর নিজের বলে মনে করেনা। বড় হবার স্তরে যখন কন্যা শিশুরা পিতার জুতাটা এগিয়ে এনে দেয় তখন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একপ্রকারের আত্মতৃপ্তির প্রশ্রয় দেখা যায়। এটাকে দেখা হয় যে তাদের কন্যা পিতার সেবা করতে শিখে গেছে। কিন্তু ঘরের ছেলেটার যে পরবারের কারও ভালো বা মন্দে কিছুই আসে যায় না তখন কিন্তু এটাকে সমস্যা মনে করা হয় না। ছেলেরা একটু উদাসই হয় বলে দায়িত্বহীনতাকে জাস্টিফাই করা হয়।
মেয়েটা বড় হতে থাকে। তাকে ভাইয়ের খোঁজ রাখতে হয়। মায়ের সাথে হাত মিলাতে হয়। বাবার ভালোমন্দ দেখারও এক অদৃশ্য দায় এসে পড়ে। উড়নচন্ডি ভাইটা কখন বাসায় ফিরলো বা বাইরে কাদের সাথে মিশছে সে নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয় খুব কম। মেয়েটা যখন সবকিছু করার পরেও শখ করে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে চায় তখনই শুনতে হয় হাজারো প্রশ্ন। মেয়ে মানুষের অত ঢ্যাং ঢ্যাং করতে হয় না। অত ঘোরাফেরার শখ করা আবার কেন?
সেই মেয়েটাই তার শখ আহ্লাদকে চাপতে চাপতে একধরনের ম্রিয়মাণ আত্মাকে নিয়ে বেড়ে উঠে। অনেক পরিবারে আবার বলা হয় বিয়ের পর স্বামীর সাথে বেড়াতে যেও। হাজার বন্ধু পাশে থাকলেও কেবল নারী বলেই সে একা হয়ে যায়। তারপর কী হয়? বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর যদি ইচ্ছা হয় তবেই বেড়াতে যাওয়া যায়।
কেবল স্বামীর ইচ্ছাই যথেষ্ট হয় না। তার পরিবারের সবকিছুকে সামলে তারপরেই কেবল ফুসরত মিলতে পারে। কর্মজীবী নারীদের অবস্থা যেন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অফিস সামলানো মেয়ে ঘরে এসে পারিবারিক দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে বিশ্রাম নেয়ার সময়টুকুও বের করতে পারেনা।
এটাও ঠিক যে আমরা আধুনিক হয়েছি। উন্নতও হচ্ছি। কিন্তু সেই আধুনিকতার প্রায় পুরোটাই এসেছে আসবাবপত্র কেন্দ্রিক। গৃহ সজ্জাতে আধুনিকা এলেও গৃহের মানুষগুলোর মগজের কিন্তু ধুলো জমতেই থাকে। তারা এখনও ঘরে বাস করা নারীদেরকে মনে করে জীবিত একজন অনুভূতিহীন মানুষ।
এই বাস্তবতার কি কোন পরিবর্তন আনতে পেরেছে এসব দিবসগুলো? এই প্রশ্নটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই করা উচিত। আমারতো মনে হয় প্রতিবার নারী দিবসের শ্লোগাননির্ভর আনুষ্ঠানিকতা না করে গতবছরের চেয়ে এ বছর কতটুকু আগালাম আমরা সেই বিশ্লেষণ হওয়াও জরুরি। এই অনুশীলনটুকু নারী ও পুরুষের উভয়েরই মগজের দুনিয়ায় কিছু ভাবনা নিয়ে আসবে।
পরিবর্তন একদম হয়নি বা হচ্ছেনা তাও বলা যায় না। তবে সেসব পরিবর্তন বেশিরভাগই হয়েছে কাঠামোবদ্ধ। অর্থাৎ, ছকে বাঁধা তালিকার টিকচিহ্নগুলো হয়তো পূরণ করা যাচ্ছে কিন্তু চিন্তার জগতে এর কতটা কী ঘটছে সে তুলনা আমরা করতে যাইনা। করতে গেলে হয়তো দিবসের আনুষ্ঠানিকতাগুলো বড্ড মেকি হয়ে উঠতেও পারে।
নারীদের অগ্রগতি বলতে যদি বোঝায় নারীরাও আজকাল উবার চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে তবে উন্নতি হয়েছে বৈকি। কিন্তু সেই নারীটি কোন অবস্থায় পড়ে উবার চালাতে এলো, এই কাজ করতে গিয়েও তাকে কতটা পারিবারিক বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে সেই গল্পগুলো হয়তো এই আগানোটাকে একবাক্যে সার্টিফাই করতে পারবে না।
আমরা এখন বৈশ্বিক অস্থিরতার যুগে বাস করছি। অর্থনৈতিক অস্থিরতা নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবীকে। যেকোনো অস্থিরতায় প্রথম শিকার হয় নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা কারণ তারা নির্ভরশীল হয়। ঠিক এমন একটি অস্থির সময়ে নারী দিবসের শ্লোগান ঠিক করা হয়েছে “ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন”- এই শ্লোগানটি হয়তো পশ্চিমা আধুনিক বিশ্বের জন্য ঠিকাছে কিন্তু আমাদের দেশের নারী সমাজ কতটা প্রযুক্তিতে এখনও এগিয়েছে সেটিও একটি প্রশ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে লক্ষ নির্ধারিত হয়েছে।
সেই স্মার্ট বাংলাদেশে যদি আগে স্মার্ট চিন্তার মানুষ তৈরি করা না যায় তাহলে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি কেবল ব্যবহারিকই হয়ে থাকবে। প্রযুক্তির এই কল্যাণকে নারীর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে অবশ্যই আলাদা কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। আর এই কাজটি করার দায়িত্ব আমাদের নারী ও শিশু বিষয়ক যতগুলো কর্তৃপক্ষ আছে তাদের। কিন্তু আফসোস হচ্ছে তারা নিজেরাই কতটা চিন্তা চেতনা বা প্রযুক্তির উদ্ভাবনে আগ্রহী সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। আসলে আগে নির্ধারণ করতে হবে নারীর জীবনের উপর অধিকার কার কতটুকু।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।