বার্তাকক্ষ ,,আজও মজুরি নির্ধারণ হয়নি গৃহপরিচারিকাদের। নেই সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক ছুটি। ফলে মাসে ৩০ দিনই কাজে যেতে হয়। এর মধ্যে অনেক গৃহপরিচারিকা অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে জানেন না। ফলে নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হন। এসবের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর অন্যের পরিবারের সব কাজ করে যাচ্ছেন গৃহপরিচারিকারা।১৫ বছর ধরে গৃহপরিচারিকার কাজ করছেন ময়মনসিংহ নগরীর থানাঘাট এলাকার বাসিন্দা নাজমা বেগম (৫০)। ব্রহ্মপুত্র বাঁধের পাশের বস্তিতে বসবাস করেন। নিজেদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সোমবার (৭ মার্চ) সকালে এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন নাজমা।
তিনি বলেন, ‘গায়ে-গতরে খাইটে দিন আনি দিন খাই। কাম করলে টেহা পাই, করতে না পারলে পোলাপান নিয়ে উপাস থাহা লাগে। অধিকার এবং দায়িত্ব কী বুঝি না।’নাজমা বেগম জানিয়েছেন, ১৫ বছর আগে তিন ছেলেমেয়ে রেখে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন তার স্বামী। এরপর থেকে মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান।
সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বিকালে ফিরি উল্লেখ করে নাজমা বেগম বলেন, ‘তিনটা বাসায় কাজ করি। সকাল ৮টায় ঘর থেকে বের হয়ে প্রথম বাসায় ধোয়া-মোছা এবং তরকারি কাটার কাজ করি। এই বাসা থেকে মাসে ১৫০০ টাকা পাই। এভাবে আরও দুই বাসায় কাজ করে বিকাল ৪টায় ঘরে ফিরি। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা হয়। তিন বাসা থেকে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা পাই। প্রতিদিন কাজে যেতে হয়। কোনও ছুটি নেই। এই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার খরচ চালাই।’
শুধু নাজমা বেগম নন, ময়মনসিংহের ২৫-৩০ হাজার গৃহপরিচারিকার এই জীবনযুদ্ধ নিত্যদিনের। তাদের অধিকাংশই থাকেন বস্তি ও ঝুপড়ি ঘরে। কারও কাঁধে সংসারের দায়িত্ব আবার কারও কাঁধে পরিবার-পরিজন পরিচালনার দায়িত্ব। ফলে প্রতিদিন জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের।নগরীর থানাঘাট এলাকার বাসিন্দা হাসি আক্তার (৪০) বলেন, ‘স্বামী ভ্যানগাড়ি চালান। তার আয়ে সংসার চলে না। তাই তিনটি বাসায় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি। তিন বাসা থেকে মাসে চার হাজার টাকা রোজগার হয়। এই টাকা দিয়ে সংসার চলে।’
কাজ করার সময় কোনোদিন গ্লাস ও কাচের জিনিসপত্র পড়ে ভেঙে গেলে বাড়ির মালিকের স্ত্রী গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ হাসি আক্তারের। তিনি বলেন, ‘গালিগালাজ মাঝেমধ্যে শুনতে হয়। মানিয়ে নিয়েছি। অনেক সময় কম বয়সী নারীরা বাসাবাড়িতে বাড়ির মালিকদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। তবে আমি এমন বিপদে পড়িনি। আমাদের কোনও ছুটি নেই। অসুস্থ হলে মাঝেমধ্যে বাড়ির মালিককে বলে যাই না। এ ছাড়া মাসে ৩০ দিনেই কাজে যেতে হয়। কাজে না গেলে টাকা দেয় না।’
চরাঞ্চল থেকে নারীরা শহরে এসে বাসাবাড়িতে কাজ করেন উল্লেখ করে নগরীর বাসিন্দা সুমি আক্তার বলেন, ‘আমি তিন বাসায় কাজ করি। সকাল ৮টায় বাসা থেকে বেরিয়ে বিকালে ফিরি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনও ছুটি পাই না। অসুস্থ হলে কেউ সহায়তাও করে না।’ময়মনসিংহে কতজন গৃহপরিচারিকা রয়েছেন তার হিসাব নেই জেলা মহিলা পরিষদের কাছে। পরিষদের সাবেক সভানেত্রী মাহমুদা ফেরদৌসী হেলেন বলেন, ‘কি পরিমাণ নারীরা বাসাবাড়িতে কাজ করেন তার হিসাব জানা নেই। তবে ২৫-৩০ হাজার নারী বাসাবাড়িতে কাজ করেন বলে শোনা যায়। এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’
এসব গৃহপরিচারিকা দরিদ্র পরিবারের উল্লেখ করে মাহমুদা ফেরদৌসী বলেন, ‘অনেকে বস্তিতে বসবাস করেন। এর মধ্যে শিশু-কিশোরীও রয়েছে। কোনও গৃহপরিচারিকা কাজ করতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে মহিলা পরিষদে আসেন। আমরা তখন তাদের পাশে দাঁড়াই। তবে নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। অনেকেভয়ে প্রকাশ করেন না।’
গৃহপরিচারিকারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় জানিয়ে মাহমুদা ফেরদৌসী আরও বলেন, ‘তাদের সচেতন করতে মাঝেমধ্যে সভা-সেমিনারের আয়োজন করে থাকে মহিলা পরিষদ। তবে তাদের অধিকার সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য নারী দিবস এবং বিশেষ দিবসে প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এতে বেতন, ছুটি ও অন্যান্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন তারা।’
গৃহপরিচারিকাদের মজুরি নির্ধারণ ও ছুটির বিষয়ে সরকারের ভাবনা কী জানতে চাইলে ময়মনসিংহের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য মনিরা সুলতানা বলেন, ‘গৃহকর্মকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনের আলোকে প্রণীত এই নীতিতে গৃহপরিচারিকাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সুরক্ষা, কল্যাণ, অবকাশ, বিনোদন, ছুটিসহ মর্যাদাসম্পন্ন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালার আলোকে গৃহপরিচারিকাদের কর্মঘণ্টা, ছুটি এবং মজুরি নির্ধারণে আইন প্রণয়নের কাজ করে যাচ্ছে সরকার। আইন পাস হলে গৃহপরিচারিকাদের অধিকার রক্ষিত হবে। সেইসঙ্গে তাদের ওপর নির্যাতন হলে আইনের মাধ্যমে বিচার হবে। তখন নির্যাতনও কমে আসবে।’