বার্তাকক্ষ ,,আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর যাতে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে কাস্টমস অ্যাক্ট ও আয়কর আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইন দুটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে গিয়ে যেন সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি করের চাপ দেওয়া না হয় এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট আলোচনায় ইআরএফ’র পক্ষে ২৩ দফা বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন ইআরএফ’র সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। এ সময় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ও অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ইআরএফ’র বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়, এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। ভারত সরকার সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৭ লাখ রুপি নির্ধারণ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সীমিত আয়ের জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ব্যক্তি খাতে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে আগামী বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। পরের দুই বছরও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। এ বাড়তি রাজস্ব আহরণে করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো, অটোমেশনের মাধ্যমে কর কম্লায়েন্স নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ধাক্কা সামলাতে এখন থেকেই গতিশীল রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলার কথা বলছে ইআরএফ। সংগঠনটি ডব্লিউটিও বাউন্ড ট্যারিফ কার্যকর করার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম আগামী অর্থবছর থেকেই শুরু করা দরকার। এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতেও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
২৩ দফা প্রস্তাবে বলা হয়েছে—এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়টি বিবেবচনায় রেখে শুল্কহার যৌক্তিক করার কাজ আগামী বাজেট থেকেই শুরু করার উচিত। শুল্কহার এলডিসিগুলোর গড় শুল্কহারের তুলনায় বেশি এবং প্রোটেকটিভ ট্যারিফ গড়ে ২৮ শতাংশ। এ হার কমিয়ে আনা উচিত, যাতে এফটিএ করার পর রাজস্বের ধাক্কা একবারে না আসে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করা, নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এনবিআরের বিভিন্ন সেবা বিডা’র ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে যুক্ত করা এবং বিভিন্ন সেবা ফি অনলাইনে এক স্লিপে নেওয়ার ব্যবস্থা করা কথা বলা হয়েছে। সরকার বিভিন্ন খাতে যে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে এবং এর ফলে অর্থনীতিতে কী ধরনের সুবিধা আসছে, তার একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন চেয়েছে এনবিআর।
এছাড়াও বেসরকারি খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা তিন বছর করা, আগাম কর রিফান্ড ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, ইটিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করা, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতা অর্জনে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।পাচার করা অর্থ দেশে আনার জন্য চলতি বাজেটে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার সুফলও মিলছে না, উল্লেখ করে এ অবস্থায় মুদ্রা পাচার রোধে ভারত, চীন অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার করার প্রস্তাব করেছে ইআরএফ।
ইআরএফ’র ২৩ দফা প্রস্তাব প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, বাজেটে যদি নগদ টাকা দেওয়া হয় ও ইনসেন্টিভ দেওয়া হয়, তাহলে মনে হয়, আমি পেলাম। ইনডাইরেক্ট যখন যায়, তখন মনে হয়, আমি কিছু পেলাম না। বাজেট করা হয় স্বল্প আয়ের মানুষদের অবস্থার উন্নতির জন্য। লোয়ার মিডল ক্লাসকে মিডল ক্লাসে আনার জন্য। মিডল ক্লাসকে আপার মিডল ক্লাসে নেওয়ার জন্য। পার কেপিটা ইনকাম বাড়ানো জন্য। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমরা কী পেলাম, আমার হাতে এনে দাও, আমার কাছে এনে দাও। এটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। বাজেটে কোথায় ট্যাক্সের ছাড় দেওয়া হয়, সেটা আমরা দেখি।
তিনি বলেন, ২০২১ সাল থেকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণা নিয়ে আমরা বাজেট প্রণয়ন করি। মধ্য শ্রেণির সংখ্যা বেশি। তাদের কনজ্যুমার আইটেমও বেশি। এ সাইজটার ডিমান্ডটা পূরণ করছে বিদেশ থেকে আমদানি করে—মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে প্রেশার কুকার, টিভি ও ফ্রিজ। আমরা চাই, বিদেশ থেকে ইম্পোর্টের শেয়ার জিরো হয়ে যাক। এটাকে টার্গেট করে যদি আমরা ইন্ডাস্ট্রিশিয়াল ডেভেলপমেন্টকে সাপোর্ট করি আমাদের পলিসি দিয়ে, তাহলে আমাদের জিডিপি, ফরেন কারেন্সি সেভিংস, ফরেন কারেন্সি ইনকাম, কর্মসংস্থান সমস্যা দূর হবে।
তিনি বলেন, আমাদের হেভি ইন্ডাস্ট্রিতে যেতে হবে, বড় বড় ইনভেস্টে যেতে হবে। চ্যালেঞ্জিং ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যেতে হবে। সেখানে দেশের বড় গ্রুপকেই যেতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এসএমইতে যেতে হবে। বড়রা যদি এসএমই’র জায়গাটা খেয়ে দেয়, তাহলে বড় ইনভেস্টমেন্ট কোথা থেকে আসবে। বড় শিল্পগোষ্ঠি চানাচুর বানাতে যায়। তাহলে ছোট উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে কে কোন ব্যবসা করবে, সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দরকার আছে। এটা আমাদের বিষয় না। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এটা ঠিক করে দেওয়ার কথা বলেছি। এটা মনে হয় দেখার দরকার আছে। কারণ, কোম্পানি আইনে নাকি এ সুযোগ অবারিত করে দেওয়া আছে। দরকার হলে সেই আইন ঠিক করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এনবিআর বদলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের উৎসাহ দেবেন। আপনাদের সহযোগিতা চাই।