শেখ শাহরিয়ার জামান
সাড়ে চার বছর পর চতুর্থবারের মতো ইউনিভার্সেল পিরিওডিক রিভিউতে (ইউপিআর) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন প্রশ্ন ও মন্তব্যের জবাব দেবে বাংলাদেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, যথেচ্ছ ধরপাকড়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শ্রমিক অধিকারসহ নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো এবারের ইউপিআর-এ প্রাধান্য পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের অবস্থান এবং তারা কে কী বলতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা আছে সরকারের। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে কয়েকটি দেশ, যেমন- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, জাম্বিয়ার অবস্থান কিছুটা নেতিবাচক। অন্যান্য দেশ বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন নেতিবাচক প্রশ্ন বা মন্তব্য বা সুপারিশ করলেও বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরে।
নেতিবাচক মন্তব্যকারী দেশগুলোর প্রতি স্বাভাবিকভাবে বেশি নজর দেওয়া দরকার, যাতে তারা কঠোর অবস্থান না নেয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগের তিনটি ইউপিআরে যেসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশ বারবার সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো— মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার অধিকার, মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা, জাতিসংঘ মানবাধিকার ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি, নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকার এবং শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৮ সালের তৃতীয় ইউপিআরে ১০৫টি দেশ বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০টি দেশ তাদের বক্তব্যে ওয়েলকাম, কমেন্ড, রিকগনাইজড-সহ বিভিন্ন ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেছে। অপরদিকে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেনি তাদের বক্তব্যে।’
উল্লেখ্য, গতবারের ইউপিআর-এ যুক্তরাজ্য বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম, মত প্রকাশ ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলকে লক্ষ্য করে মত প্রকাশ ও সমাবেশ করার স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছিল।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাম্বিয়া। অপরদিকে ডেনমার্ক বাল্যবিবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
সোমবার (১৩ নভেম্বর) জেনেভায় স্থানীয় সময় বিকাল ২টা থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে ইউপিআরে।
এবারে কী গুরুত্ব পাবে
ইউপিআরে চলমান বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, শ্রমিক আন্দোলন, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা—এই বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
এ বিষয়ে একজন সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘গত চার বছরে বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আশা করা যায়, এ বিষয়ে প্রশ্ন কম হবে। কারণ, এর ভালো উত্তর বাংলাদেশের কাছে আছে।’
অপরদিকে রাজনৈতিক সহিংসতা, শ্রমিক আন্দোলন, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, মত প্রকাশে স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কয়েকটি শক্তিশালী দেশ বিবৃতি দিয়েছে বা মন্তব্য করছে। আশা করা যায়, ইউপিআর মেকানিজমে তারা আবার সেটি তুলে ধরবে।
ইউপিআর-এর রাজনীতি
জাতিসংঘে যত মেকানিজম আছে, তার মধ্যে ইউপিআর হচ্ছে একমাত্র মেকানিজম, যেখানে একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য বা সুপারিশ করে থাকে। সে কারণে বিষয়টি অত্যন্ত রাজনৈতিক, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও অন্যান্য স্বার্থ এখানে বড় ভূমিকা রাখে।
ইউপিআর সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন—এমন একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘‘আলোচনা শুরুর আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং তাদের মনোভাব ও ‘বাংলাদেশের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের জন্য তারা’ কী ধরনের সুপারিশ করতে পারে, সে বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করা হয়।”
আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘অনেক দেশ যাদের কাছে বাংলাদেশ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের ভালো সম্পর্ক থাকলে, তারা এসে বলে—কী বলতে হবে সেটি লিখে দাও। আমরা বলে দিচ্ছি। তবে ওই দেশগুলোর ইউপিআরের সময়ে বাংলাদেশও ভালো কথা বলে।’
ইউপিআরের খেলোয়াড় কারা
মূলত সদস্য রাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে এই ফোরামে ব্যাখ্যা দেয়। এছাড়া সুশীল সমাজ ও এনজিও প্রতিনিধি এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলও ইউপিআরে প্রভাব রাখার চেষ্টা করে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, বিভিন্ন দেশ এখানে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে থাকে। এর পাশাপাশি ওই দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও এখানে বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকে।
এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের আন্তর্জাতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে এবং সরকারকে বিব্রত করার জন্য বিভিন্ন বিদেশি কূটনীতিক বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বলে তিনি জানান।
