বার্তাকক্ষ
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। প্রতি বছর রমজান মাসের শেষে আসে এই ঈদ। মহাউৎসবের সঙ্গে মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করেন। এভাবে রোজা ও ঈদের ধর্মীয় নিয়মাবলি যথাযথ পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় স্থান-কালভেদে ঈদ উদযাপনের পারিপার্শ্বিক নিয়মের কোনও হেরফের কি ঘটছে, নাকি পাল্টে যাচ্ছে ঈদ উৎসবের রীতিনীতি! ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। অনেকেই মনে করেন, আগেকার ঈদের সেই আনন্দ আর বর্তমানের আনন্দের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কেউ বলেন, এখনকার ঈদে নতুনত্ব এসেছে। আবার কেউ বলেন, সেই ঈদ আর নেই, মানে আগের আনন্দটা এখন আর পুরোপুরি পাওয়া যায় না। তার মানে কী, ঈদ কি কখনও হারায়, নাকি হারিয়ে যায়!
তিনি লিখেছেন,‘ঈদের আগের দিন ভীষণ ব্যস্ততায় কাটতো আব্বা-আম্মার। একজন বাজারে অন্যজন রান্নাঘরে। শবে কদরের দিন পাটায় বেটে মেহেদী দেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। আমাদের বাসায় আমরা আট ভাই-বোন ও ফুপাতো ভাই কৃষক লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম, ওনার তিন ছেলেমেয়ে, ভাবি (এক ছেলে শহীদ তিতাস)—সবাই আমরা একসঙ্গে ঈদ করতাম। তখন এখনকার মতো চাইলে গরু ও খাসির মাংস পাওয়া যেতো না। পাড়ায় গরু-খাসি জবাই করে মাংসের ভাগ কিনে আনা হতো। ঈদে গজ কাপড় কিনে নিজেরাই সেলাই করে ড্রেস বানাতাম। সেজন্য অবশ্য ঈদ উপলক্ষে যেসব ম্যাগাজিন বের হতো, সেগুলো ছিল একমাত্র অবলম্বন।’
সারা দিন বান্ধবীদের বাসায় ঘোরাঘুরি, রাতে আমার এক ভাই ও ভাবির (কায়সার ভাই) বাসায় টিভির অনুষ্ঠান দেখতাম। তখনকার সময় টিভি ছিল ছোট, কিন্তু দর্শক ছিল বেশি। আর এখন বড় টিভি, দর্শক একজন। আগে রিমোট কন্ট্রোল ছিল না। ঈদের দিন সকালে ছেলেরা আগে গোসল করে, নতুন কাপড় ও আতর মেখে হালকা নাস্তা খেয়ে নামাজে যেতো। বাকি আমরা সবাই ঘর গুছানো, টেবিল সাজানো, সেই সঙ্গে নিজে রেডি হওয়া—এই ছিল ঈদের শুরু।’
দুই দশক আগেও এই ছিল ঈদের দিনের প্রচলিত রুটিন। হাসনাত ফাতেমার মতো সেই দিনগুলো আজকে এসে অনেকে মিস করেন বটে। কিন্তু একে কি হারিয়ে যাওয়া বলে?
ঈদের নামাজ শেষে বাবার কাঁধে শিশুঈদের নামাজ শেষে বাবার কাঁধে শিশু
কলেজ পড়ুয়া রিসতা হান্নান তাদের ঈদ উদযাপনের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘ঈদের পোশাক ইনস্টাগ্রাম দেখে ডিজাইন করে বানিয়ে নিয়েছেন রমজানের আগেই। রোজার মাসে কেবল মিলিয়ে মেকআপ, জুয়েলারি কিনেছেন। সারা দিন কী করে কাটে জানতে চাইলে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। দুপুরে কোনও না কোনও আত্মীয়ের বাসায় সবাই একত্রিত হই। তারপর বন্ধুরা কোনও কফিশপে সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, বাসায় ফিরে নেটফ্লিক্স বা ইউটিউবে সিনেমা দেখি।’ ঈদের টেলিভিশন আয়োজনের নাটক বা অন্যকিছু দেখেন কিনা প্রশ্নে বলেন, ‘না, তেমন কিছু দেখা হয় না।’
ঈদে মেহেদি দেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাইয়েদা তাবাসসুম বলেন, ‘মেহেদি টিউব কেনা হয়, আলসেমিতে দেওয়া হয় না। আর ঈদে মেহেদি দিতে মা উৎসাহ দেন, আমার ভালো লাগে না। হাত/নেল গ্লিটার্স দিয়ে সাজাতে ভালো লাগে।’
সকালে ঈদ কীভাবে শুরু হয় জানতে চাইলে এ লেভেল পড়ুয়া রাব্বি বলেন, ‘ঈদে নামাজ পড়তে যাই পাশের মসজিদে। এসে ঘুমাই। তারপর যখন ঘুম ভাঙে, তখন উঠে বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যান করি। আগে থেকে কিছু করা হয় না। কারণ, এদিন সবার পরিবারই চায় একসঙ্গে থাকতে। মা সবসময় বলেন, ঈদে এটা করতাম, ওটা করতাম। আমি তো এরকমই ঈদ দেখছি।’
বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের অন্যতম প্রধান সংগঠক ডা. সারোয়ার আলী মনে করেন না—উৎসব হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি ৫০-এর দশক থেকে ঢাকায়। এখানে মহল্লাভিত্তিক উৎসব ছিল। সেটা বদলেছে। তবে সকালবেলা উঠে গোসল করে মসজিদে যাওয়া এখনও আছে। ঈদ উৎসবের আয়োজনে বরাবরই বিত্তভেদে পার্থক্য ছিল, এখনও আছে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই নতুন কাপড় পরার চেষ্টা করে, সেটা এখনও দেখি। উৎসবের রূপ বদলেছে মনে হয় না। আরেকটা বিষয় কিছুটা বদলেছে। আমাদের ছেলেবেলায় তখন ফ্রিজ ছিল না, ঈদের চাঁদ সংবাদ পাওয়ার পর মা-খালারা সারা রাত ধরে রান্না করতেন। সেটা একেবারেই নেই। কিন্তু তারপরেও উৎসব হারিয়ে গেছে বলা যাবে না।’
