বার্তাকক্ষ
গত ৪ এপ্রিল বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট। আসরের নামাজ আদায় করে নিজ কর্মস্থলে হাজির হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া। এর আগ থেকেই দুজন বৃদ্ধ তার অফিস কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন তার সাক্ষাৎ পেতে। অফিসে ঢুকেই তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন বাচ্চু মিয়া।
বাচ্চু মিয়া ঠিকভাবে দুজনকে চিনতে না পারলেও খুব আগ্রহের সঙ্গে কথাবার্তা এগিয়ে নিলেন। দুজনের একজন আব্দুল মালেকের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে ভর্তি আছেন ঢামেকের মেডিসিন বিভাগে। মালেকের স্বজন না থাকায় বাচ্চু মিয়ার সহায়তা নিতে চান তিনি। বৃদ্ধের কথা শুনে দায়িত্ব নিলেন বাচ্চু মিয়া।
তিনি মালেককে বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়ে আপনার জরুরি কাজ মিটিয়ে আসেন। আমাকে আপনার ফোন নম্বর দিয়ে যান। যেকোনও সমস্যা আমাকে ফোন করে জানালে আমি ছুটে যাবো আপনার স্ত্রীর কাছে।
আলোচনার একফাঁকে দুজনকে তার সঙ্গে ইফতার করে যেতে বললেন। পরে তাদের পছন্দমতো খাবারের বিষয়টি জেনে ফুটপাত থেকে ইফতারি কিনে আনলেন। দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বসে পড়লেন ইফতার করতে।
নিজ দায়িত্বের বাইরে গিয়ে রোগীদের সেবা করার মতো এমন অনেক মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন ঢামেকের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া (৫৯)।
নানা কারণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল দেশব্যাপী সুপরিচিত, তেমনি বাচ্চু মিয়াও দায়িত্বের কারণে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি মনে করেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, এই মেডিক্যালে যেই আসুন, সবাই তার কাছে সমান। সকাল থেকে দুপুর, সন্ধ্যা থেকে রাত; রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এর আগে করোনা মহামারির সময় যখন সবাই নিজের জীবনের কথা ভাবতে ব্যস্ত ছিলেন, তখন বাচ্চু মিয়া তা চিন্তা না করে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেবা করতে গিয়ে তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
পরিদর্শক বাচ্চু মিয়ার প্রধান কাজ হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, আহত-নিহতের প্রতিবেদন তৈরি করা। অথচ এর বাইরে গিয়ে প্রতিদিন আরও অনেক কাজ করে থাকেন তিনি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতিদিনই কোনও না কোনও রোগীকে সহযোগিতা করা, জরুরি বিভাগের সামনে রোগী বহনকারী ট্রলি টানা, রোগীকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, ওষুধ কিনে দেওয়া, মেডিক্যালে কেউ মারা গেলে মরদেহ বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দেওয়া, এমন অনেক মানবিক কাজে ভরসার নাম হয়ে উঠেছেন বাচ্চু মিয়া।
ঢামেকের জরুরি বিভাগের সামনে, রাস্তার পাশে, হাসপাতালের বাইরে যে কেউ বিপদে পড়লেই হাজির হন ওই বাচ্চু মিয়ার কাছে। এমন সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় সবাই পছন্দ করেন বাচ্চু মিয়াকে। ওয়ার্ড বয় থেকে চিকিৎসক; দোকানদার, হকার, ভিক্ষুক; সবাই এক নামেই চেনেন পুলিশ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়াকে।
বাচ্চু মিয়াবাচ্চু মিয়া
বাচ্চু মিয়ার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার মামুন নগর ইউনিয়নের বাড়ি এলাকায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চার নম্বর। ১৯৮৪ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। শুরুতে রাজারবাগ পরিবহন, দুই নম্বর কোম্পানির টুআইসি ও ডিএমপির বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালে ঢামেকে পুলিশ ফাঁড়িতে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর একই বছর শান্তি রক্ষা মিশনে যান আফ্রিকার সুদানে। সেখানে ১ বছর ২২ দিন পার করে দেশে ফিরে যোগ দেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। ২০১৬ সালে দায়িত্ব পান ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির। ২০২৪ সালের অক্টোবরে অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে তার।
বাচ্চু মিয়ার পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী মনোয়ারা বেগম আর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়ে মুক্তা ও ঋতুবর্ণাকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে মাসুদ রানা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে এখন চাকরিপ্রত্যাশী। ছোট ছেলে মামুন ইংরেজিতে অনার্স পড়ছেন। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে পুরান ঢাকা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
বাচ্চু মিয়া বলেন, মানুষকে সাহায্য করে আমি যে সুখ পাই, এমনটা আর অন্য কোনও কাজে পাই না। হাসপাতালে কত অসহায় মানুষ আসে, রোগী আসে; যারা হাসপাতালে থাকেন, কেবল তারাই জানেন কত কষ্ট। কাউকে না কাউকে এসব লোকজনকে সহযোগিতা করতে হবে। রাত ৩টা কিংবা ৪টা, যতটাই হোক, আমি যদি অসুস্থ না থাকি, প্রয়োজনে ডাকলেই আমি চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় থাকি। সব সময় বাসায় সময় দিতে পারি না। এক দিন বাসায়, পরের দিন পুলিশ ফাঁড়িতেই থেকে যাই। এভাবে চলে যাচ্ছে আমার সময়। যখন-তখন বিপদে ডাক আসে। এ জন্য বেশির ভাগ সময় ফাঁড়িতেই অবস্থান করি।
করোনার সময়ের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনার সময় কী একটা হাহাকার ছিল দেশে। মেডিক্যালে সন্তান বাবার সামনে যেতে চায় না। ভাই বোনের কাছে যেতে চায় না। এমন বহু ঘটনা আমি দেখেছি। কিন্তু আমি পিছিয়ে যাইনি। বহু রোগীকে হাসপাতালে রেখে চলে গেছে স্বজনরা। আমি তাদের সহযোগিতা করেছি। তাদের ওষুধ ও খাবার এনে দিয়েছি। রোগীদের পাশে থেকে আমিও একদিন করোনায় আক্রান্ত হই। টানা ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আল্লাহ আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন। যত দিনই বাঁচি, মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে থাকতে চাই।
সন্তানদের বিষয়ে বাচ্চু মিয়া বলেন, দুই ছেলেকে পুলিশ বাহিনীতে দেওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। তারা যেখানেই যাক, আমি চাই তারা যেন বাবার মতো মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তাহলেই আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে।
