বার্তাকক্ষ
সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে যান রমিজ। মাসে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও নিয়মিত বেতন পান না তিনি। তাকে বেতন দেওয়া হয় দৈনিক ভিত্তিতে। মাসের ২০ দিনই কাজ থাকে না বলে জানান তিনি। তার ওপর ৭০০ রিঙ্গিত কেটে নেওয়া হয় তার বেতন থেকে। রমিজের মতো একই সমস্যায় ভুগছেন আরও অনেক প্রবাসী কর্মী।
মালয়েশিয়ায় গিয়ে কর্মীরা কাজ পাচ্ছেন না। সম্প্রতি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে মালয়েশিয়ার ভিসা বাণিজ্য। কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ না পাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন অন্তত হাজারখানেক বাংলাদেশি কর্মী। শুধু বাংলাদেশি নন, নেপাল থেকে যাওয়া কর্মীরাও আছেন একই সমস্যায়। তাদের কাছে নেই পাসপোর্ট। সে দেশে যাওয়ার পর কথিত এজেন্ট তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেয়।
রমিজ জানান, আমরা এখানে অনেক খারাপ অবস্থায় আছি। কোম্পানির কাজের জন্য কেউ সাড়ে ৪ লাখ, আবার কেউ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে আসছি। এখানে এসে দেখি মাসে ১০ দিনও কাজ থাকে না। বেতন হওয়ার কথা ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত। অথচ আমাদের ২ দিন বা ৩ দিন কাজ করিয়ে বসিয়ে রাখে। না ঠিকমতো খাইতে পারি, না পারি নিরাপদে থাকতে। কারণ, আমাদের সঙ্গে পাসপোর্টও নই।
রমিজ ছাড়াও কাজ না পেয়ে বিপদে আছেন আরও ৪৭ জন কর্মী। গত ৩০ ডিসেম্বর বিমানবন্দর থেকে ওই ৪৭ জনকে সেরি কেম্বাঙ্গান এলাকার একটি আবাসিক ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘুমানোর জন্য কোনও বিছানা ছিল না। আর সবার ব্যবহারের জন্য ছিল মাত্র একটি টয়লেট। সেটির অবস্থাও ভালো না। এই ৪৭ জনের মধ্য থেকে ১০ জনকে গত ১৩ মার্চ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ সময় তাদের নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কর্মীরা। পরে গত ২২ মার্চ মুক্তি পান তারা। এখনও ৯ জন আছেন মালয়েশিয়ার জেলে।
কয়েক দিন আগে নেগ্রি সেম্বিলানের একটি ট্রানজিট হোম থেকে ২২৬ বাংলাদেশি ও নেপালি কর্মীকে উদ্ধার করে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। সেই ট্রানজিট হোমে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন তারা। দেশটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পান—এমন পরিবেশে বসবাস করা খুবই বিপজ্জনক। অভিযানের পর মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী শিব কুমার জানান, তারা (কর্মীরা) খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং কান্নাকাটি করছিলেন।
ক্ল্যাংয়ের সাবেক এমপি চার্লস সান্তিয়াগো টুইটারে শ্রমিকদের নিম্নমানের জীবনযাপনের একটি ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায়, ৭১ জন বাংলাদেশি শ্রমিক একটি ফ্ল্যাটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সান্তিয়াগোর ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে যে টাকা খরচ করে এসেও কাজ পাননি তারা। ভিডিওটি ধারণকারী ব্যক্তি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, এক মাস আগে এসব শ্রমিককে দেশে (মালয়েশিয়ায়) আনা হয়েছিল। তাদের ভালো খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি। তাদের সেই অ্যাপার্টমেন্টে একটি টয়লেট, যা সবাইকে ভাগ করে নিতে হয়েছিল, তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা ‘বিপজ্জনক’।
মালয়েশিয়ায় শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টরা জানান, ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে— প্রচুর নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাতে কর্মীরা এখানে এসে বিপদে পড়ছেন। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনা। যেটাকে মানবপাচার হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মালয়েশিয়ায় বিপদে পড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন অ্যান্ডি হল। তিনি জানান, প্রবাসী কর্মীদের অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে গত ছয় মাসে। বাংলাদেশি এই কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া দুই দেশেই তারা শোষণের শিকার হয়েছেন।
এদিকে কাজ না পাওয়ার বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন। এক বিবৃতিতে হাইকমিশন জানায়, মালয়েশিয়ায় আসার পর কিছু সংখ্যক বিদেশি কর্মী সঠিক কাজ পাচ্ছেন না বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্যক্তিগত সোর্স থেকে জানা গিয়েছে। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মীও সমস্যায় পড়েছেন বলে বাংলাদেশ হাইকমিশন অবহিত হয়েছে। এ বিষয়ে হাইকমিশন নিজস্ব উদ্যোগে এবং মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের সহায়তায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু সংখ্যক কর্মীকে কাজ প্রদানে নিয়োগকর্তাকে বাধ্য করতে সমর্থ হয়েছে। বাকি কর্মীদের নতুন নিয়োগকর্তার অধীনে নিয়োগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন আরও জানায়, মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়ার বিষয়ে সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে বাংলাদেশ হাইকমিশন মনে করে। মালয়েশিয়া সরকারের বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমোদন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলে একজন কর্মীও কর্মহীন হওয়ার কথা নয়। কারণ, মালয়েশিয়ায় দেশব্যাপী লেবার ডিপার্টমেন্টের শাখা-প্রশাখা রয়েছে। একমাত্র তারা যদি সঠিক যাচাই-বাছাই করে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আবেদন অনুমোদন করে, তাহলেই বিদেশি কর্মীদের সঠিক চাকরি, কর্ম পরিবেশ, আবাসন ও মজুরি নিশ্চিত হবে। এছাড়া, মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী, দেশি-বিদেশি সব কর্মীর আইনগত সব অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্ব লেবার ডিপার্টমেন্টের ওপর এবং সে লক্ষ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে সাংগঠনিক ও আইনগত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কোনও দেশের দূতাবাসের পক্ষেই শতভাগ যাচাই-বাছাই করে কর্মী নিয়োগের ডিমান্ড সত্যায়ন করা সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে, দূতাবাসকে আবশ্যিকভাবে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করতে হবে। এটা বাংলাদেশসহ সব সোর্সিং কান্ট্রির দূতাবাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশ দূতাবাস আনুমানিক ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সঠিক আছে কিনা, সে সংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে ডিমান্ড সত্যায়ন করে থাকে। বাকি আনুমানিক ৫ শতাংশ ডিমান্ডের বিপরীতে দূতাবাস নিয়োগকর্তার অফিস/প্রজেক্ট সাইট ইত্যাদি ভিজিট করে সত্যায়ন করে থাকে। শতভাগ প্রজেক্ট/ফ্যাক্টরি তথা হাজার হাজার নিয়োগ প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ভিজিট করা দূতাবাসের পক্ষে বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব। এটা মালয়েশিয়ার লেবার ডিপার্টমেন্টের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব। তাই, মালয়েশিয়ার লেবার ডিপার্টমেন্টের ছাড়পত্রের ওপর আস্থা রেখে শ্রমিক পাঠানোই যুক্তিসঙ্গত। অন্যান্য সব শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ এটাই করছে। এছাড়া, শতভাগ প্রজেক্ট দূতাবাস কর্তৃক ভিজিট করে ডিমান্ড সত্যায়ন করতে হলে কর্মী আগমনের গতি এতই ধীর হবে যে যেটা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। অপরদিকে, প্রতিযোগী দেশগুলো সেই সুযোগ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ তার যথাযথ সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। তবে, এক্ষেত্রে ডিমান্ড সংগ্রহকারী বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের মালয়েশিয়ার সহযোগী এজেন্সির মাধ্যমে নিয়োগকর্তার সঠিকতা এবং বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের সক্ষমতা যথাযথভাবে যাচাই করার পর শ্রমিক পাঠানোর কার্যক্রম গ্রহণ করলে শ্রমিকদের কর্মহীনতার ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে।এছাড়া মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ দূতাবাসকে কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে সতর্ক করেছে, যাতে দূতাবাস কোনও প্রজেক্ট সাইট/ কোম্পানি সরেজমিন যাচাই করতে না যায়।
মালয়েশিয়ায় কর্মীদের কাজ না পাওয়ার ঘটনা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে সে দেশের সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন লেবার ডিপার্টমেন্টের ডিজি আসরি রহমান।
অপরদিকে ঢাকায় মালয়েশিয়া হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন। তাদের একজন পুরুষ, অপরজন নারী। তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদের পর বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) তাদের মালয়েশিয়ায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) এই দুই ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন খুঁজে পেয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। এই দুই ব্যক্তির ২০টিরও বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে এমএসিসি। এই সম্পদের মধ্যে ৮টি জমিও রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেছেন, মালয়েশিয়ায় গিয়ে অভিযোগ করেন চাকরি হয় না। বাস্তবে কিন্তু এই চাকরি নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালয়েশিয়ার। আমাদের এখান থেকে সব ঠিক করে আমরা পাঠাই, ওরা যদি গ্রহণ না করে, তাহলে আমাদের কিংবা রিক্রুটিং এজেন্টকে দোষ দেওয়া যায় না।
