চর্মকার, যারা মুচি নামেই বেশি পরিচিত সমাজে। একসময় পাড়া-মহল্লার অলিতে-গলিতে তাদের হাঁক-ডাক শোনা যেত বেশ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কমে এসেছে তাদের সেই হাঁক-ডাক। এখন নির্দিষ্ট কোনও স্থানে, গলিতে কিংবা রাস্তার পাশের ফুটপাতে দেখা মেলে চর্মকার পেশার মানুষগুলোর। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে তাদের জীবনযাত্রার মান, আয়-ব্যয়, পারিশ্রমিক। কিন্তু আসলেই কি তাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয়েছে?
প্রেসক্লাব ও সচিবালয় এলাকা সরেজমিনে কথা হয় সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী সান্ডিল গোত্রের চর্মকার পেশার মানুষদের সঙ্গে।
হরে কৃষ্ণ, বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ঢাকায় থাকেন গোলাপবাগে। চারজনের সংসার তার। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী। তার প্রতিদিনের আয় গড়ে ৩০০ টাকা। রোজার মাসে আরও কমেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে দেড় শ থেকে দুই শ টাকা আয় হয় বলে জানান তিনি। সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হয়।
কৃষ্ণ বলেন, ‘যদি ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারি তাইলে ভালো-মন্দ খাইতে পারি। আর নাইলে ডাইল-ভাত খাইয়াই কোনও রকম সময়ডা পার কইরা দেই। কিন্তু কাজ কইমা গেলেই তো সমস্যা। আমার দুইডা বাচ্চা। একটা আবার স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে। আমার যে আয় হয়, এইডা দিয়া কুলায় উঠতে পারি না। এর মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, কিন্তু আমাগো তো আয় বাড়ে নাই।’
ঠাকুর চান ঋষি, দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে ছয় জনের সংসার তার। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন ছেলে-মেয়ের সবাই স্কুলে পড়ে। ছোট মেয়ে ক্লাস সিক্সে। বড় ছেলেও পড়ে একই ক্লাসে। সবার ছোট ছেলে ক্লাস ফোরে।
ঠাকুর চান বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে আমার আয় হয় ৫০০ টাকার মতো। যেই টাকা আয় হয়, তা দিয়া পোলাপানের পড়ালেখা করাইয়া খাইয়া-পইরা চলা কঠিন হইয়া পড়ে। টানাটানি কইরা চলতে হয়। পুরা মাসের আয় আর ব্যয় হিসাব করলে ব্যয়ই বেশি হয়। মাস শেষে ঋণের মধ্যে থাকি। এর মধ্যে সব কিছু দাম বেড়েছে। বাইরে আগে একটা কালি ছিল ৩৫ টাকা, একটা ব্রাশ ছিল ৫০ টাকা। এখন সেই কালি হইছে ৭০ টাকা, ব্রাশ ১০০ টাকা। তাই কালি করতেও এখন বেশি টাকা নেই।’
কেমন আছেন চর্মকাররা?
নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আমার সব ছেলে-মেয়েরে পড়ালেখা করাইছি। বড় মেয়েরে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়া দিছি। বাকি তিন ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করতেছে। আমি চাই ছেলে-মেয়েরা আমার মতো কাজ না করুক। ওরা পড়াশোনা করে সম্মানজনক কোনও চাকরি করবে এটাই চাওয়া।’
সন্তোষ ঋষি দাস, ৩০ বছর ধরে প্রেসক্লাবে মুচির কাজ করছেন। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। থাকেন গোপীবাগ। এক রুমে মেজ ছেলে, ভাই ও ভাতিজাকে নিয়ে থাকেন। মাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী। সে তার বাবার পেশাতেই কাজ করে। ছোট ছেলে সিলেটে একটি সেলুনে কাজ করে। স্ত্রী, মেয়ে আর মা থাকে গ্রামের বাড়িতে।
তিনি বলেন, ‘আগে একটা জুতার কালি কিনতাম ১০ টাকায় আর এখন কিনি ৯০ টাকায়। আগে খরচ কম ছিল। ৩০ বছর আগে জুতা কালি করে নিতাম ২-৩ টাকা। এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই আমাদের কাজের পারিশ্রমিকও বেশি। এখন জুতা কালি করতে নিই ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বর্তমানে আমার প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। প্রতিদিনের খরচ বাদ দিলে দুই থেকে আড়াই শ টাকা লাভ থাকে।’
সন্তোস জানান, কোনোমতে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে করোনার সময় অনেক মাস কাজ করতে পানেননি। তখন জমানো টাকা দিয়ে চলতে হয়েছে। সে সময় মায়ের অসুস্থতার জন্য অনেক টাকা ধার করতে হয়েছে। তারপরও জীবনের প্রতি তার কোনও আক্ষেপ নেই। এই পেশায় এসেছেন। এতেই থাকবেন।
