প্রতিদিনের ডেস্ক
নগদ ডলারের সংকটের কারণে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ডলারের লেনদেন বেড়েছে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যারা বিদেশে পড়ালেখা-চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য যাচ্ছেন, তারা নগদ ডলার না কিনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ডলার নেওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এ পদ্ধতি ঝামেলামুক্ত ও খরচ কম হওয়ায় বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, সেপ্টেম্বর মাসে আন্তসীমান্ত লেনদেনের প্রায় ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছে ভারতে। এর আগে জুন ও জুলাই এই দুই মাসে ভারতে ১৪৭ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে, যা মোট ব্যয়ের ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশের ক্রেডিট কার্ডধারীরা যুক্তরাষ্ট্রে লেনদেন করেছেন, যা ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে লেনদেন হয়েছে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ব্যাংকারদের মতে, খোলা বাজার ও ব্যাংকের মধ্যে ডলার রেটের বিস্তর পার্থক্যের কারণে ক্রেডিট কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে গত এক মাসে ডলারে ক্রেডিট কার্ডের খরচ বেড়েছে ৪ মিলিয়ন ডলার। বিদেশ ভ্রমণকারী বাংলাদেশিরা সেপ্টেম্বরে পণ্য ও সেবা খাতে খরচ করেছেন প্রায় ৪৩৬ কোটি টাকা, যা ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। আগের মাস আগস্টে এই খরচের পরিমাণ ছিল ৪১৭ কোটি টাকা বা ৪১ মিলিয়ন ডলার। গত জুলাইয়ে দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৫১২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যেখানে জুনে দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চের তথ্যে দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছেন। যা প্রায় ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং অর্থের হিসাবে এটি ৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর পরেই রয়েছেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা, তাদের ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। মার্চ প্রান্তিকে ভারতীয়রা ১০ দশমিক ১৪, সিঙ্গাপুরের ৩ দশমিক ৬৮, চীনা নাগরিক ২ দশমিক ৩৩, কানাডীয় ৩ দশমিক ৫৭ এবং জাপানিজ ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ নাগরিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছেন। সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই লেনদেনের প্রায় ৭৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে, ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে মাস্টারকার্ড ব্যবহার করে এবং ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে হয়েছে। অবশ্য, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশের অভ্যন্তরে কমেছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ডের খরচ গত আগস্টের ২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা থেকে সেপ্টেম্বরে ১৮৮ কোটি টাকা কমে ২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে টাকায় ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমেছে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত জুলাইয়ে দেশে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, যা জুনে ছিল ২ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। ব্যবহারকারীরা জানান, ক্রেডিট কার্ড এখন বিলাসবহুল কোনও বিষয় নয়, প্রয়োজনীয় একটি অনুষঙ্গ। এই কার্ডে ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের কেনাকাটা ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। প্রয়োজনে সহজে মিলছে ঋণও। সচেতন গ্রাহকের জন্য সুদ ছাড়া টাকা শোধ দিতে ৪৫ দিন পর্যন্ত মিলছে সময়। এদিকে ক্রেডিট কার্ড সেবাকে জনপ্রিয় করে তুলতে নানা ছাড় ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রথম বছরে ফ্রি সেবা, নির্দিষ্টসংখ্যক লেনদেনে প্রতি বছর বাড়তি চার্জ মওকুফ, রিওয়ার্ড পয়েন্ট সুবিধা, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য কেনাকাটায় বিশেষ ছাড়, হোটেলে থাকা ও খাওয়াসহ নানা অফার। এর ফলে দেশে এখন ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়ে সাড়ে ২২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রতি মাসে ২ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার প্রধানত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের মধ্যে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ; এরপরে খুচরা আউটলেট সার্ভিসগুলোতে হয়েছে ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ইউটিলিটি পরিশোধে ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং নগদ উত্তোলন হয়েছে ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, নগদ ডলারের সংকট থাকায় অনেকেই কেনাকাটা ও চিকিৎসা খরচসহ অন্যান্য খরচ মেটাচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। এছাড়া খোলা বাজারের ডলারের দাম ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে প্রায় ৫/৭ টাকা বেশি। সেইসঙ্গে, ডলার সংগ্রহ করতে নানান ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এর বাইরে ক্যাশ ডলারের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডে খরচ করা খুবই সহজ। তাই ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ ও লেনদেন বাড়ছে। প্রসঙ্গত,চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৭ থেকে ১২৮ টাকায়। অপরদিকে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অনুকূলে ক্যাশ ডলার বিক্রি করছে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা দরে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোমবার (১৩ নভেম্বর) খোলাবাজারে ডলার বিক্রেতা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকায় ডলার বিক্রি করতে বলে দিয়েছে। একইসঙ্গে, তাদের ১১৫ টাকা ৫০ পয়সায় কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশ ভ্রমণের সময় বাংলাদেশি নাগরিকরা কার্ড বা বহনকৃত ক্যাশ ডলারের মাধ্যমে বছরে ১ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে পারবেন। যদিও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন ব্যবহারকারীর সর্বোচ্চ সীমা ৩০০ মার্কিন ডলার।
