প্রতিদিনের ডেস্ক॥ বিয়ের পর দীর্ঘদিন চলে গেছে, সন্তান পাচ্ছেন না, এ রকম দম্পতিরা প্রায়ই পরামর্শের জন্য চিকিৎসকের চেম্বারে আসেন।বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব দম্পতির কিছু ল্যাব পরীক্ষা- নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। পরীক্ষা- নিরীক্ষায় কখনো কখনো কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, যেমন:
*বীর্যের শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকা অথবা একেবারেই না থাকা।
* শুক্রাণুর উপস্থিতি থাকলেও এগুলোর ত্রুটিযুক্ত আকৃতি এবং নিষ্ক্রিয়তা, নিশ্চলতা।
তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ল্যাব পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট প্রায় স্বাভাবিক থাকে। এসব রোগীর প্রয়োজন কিছু তথ্য, নির্দেশনা ও উপদেশ। অনেকগুলো উপদেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হচ্ছে, স্ত্রীর মাসিক চক্রের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘন ঘন স্ত্রী সহবাস করা।
এ সময়টুকু কখন?
মাসিক চক্র শুরু হওয়ার দিন থেকে আমরা জানি ১২তম দিন থেকে ১৬তম দিন পর্যন্ত এ কয়েকদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের মধ্যেই মহিলাদের ডিম্বস্ফুরণ ঘটে এবং ডিম্বটি পুরুষের শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তাই উক্ত সময়ে ঘন ঘন সহবাস হলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এই সময়কালের কথা কেন বলা হয়?
আমরা সবাই জানি একটি সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন হচ্ছে একটি শুক্রাণু ও একটি ডিম্বাণুর মিলনের মাধ্যমে নিষিক্ত হওয়া। পুরুষের বীর্যে সাধারণত অযুত সহস্র শুক্র থাকে। সাধারণ ১ মিলিতে শুক্রাণুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। নারীদের ক্ষেত্রে ডিম্বাণুর সংখ্যা কিন্তু অতটা যথেষ্ট নয়। একজন নবজাতক মেয়ে শিশু তার ডিম্বাশয়ে প্রায় ১০ লাখ ডিম্বাণু নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
বিজ্ঞাপন
এ সংখ্যা কিন্তু দিন দিন কমতে থাকে। একটা মেয়ে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছার পর ডিম্বাণুর সংখ্যা মাত্র ৩ লাখে নেমে আসে। বয়স যত বেশি বাড়তে থাকে ডিম্বাণু সংখ্যা তত দ্রুত হারে কমতে থাকে। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত কমতে থাকে।
এবার কিছু তত্ত্বগত আলোচনা করা যাক। মানুষের দু’ধরনের যৌনকোষ থাকে: পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণু এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ডিম্বাণু। শুক্রাণু যখন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিম্বাণুর সংস্পর্শে এসে নিষিক্ত হয় তখনই যাইগোট (তুমড়ঃব) নামে একটি প্রাথমিক ভ্রূণ সৃষ্টি হয়। শুক্রাণু তৈরি হয় পুরুষের অণ্ডকোষে। অন্যদিকে ডিম্বাণুু তৈরি হয় নারীর গর্ভের ভেতরে থাকা জরায়ুর দু’পাশে অবস্থিত দু’টো ডিম্বাশয়ের মধ্যে। নারীর যৌন জীবন শুরু হয় সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হওয়ার সময় থেকে। সাধারণত ১১ থেকে ১৫ বছরের মেয়েদের মাসিক শুরু হয়ে যায়। একেকটি মাসিক চক্র সাধারণত ২৮ দিনের হয়। মাসিক চক্রের প্রতিদিনই জরায়ু সহ জননতন্ত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। হরমোন এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। মাসিক চক্র যেদিন শুরু হয় সেদিন থেকেই জরায়ুর ভেতরের আস্তরণে পরিবর্তন হতে থাকে। এ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জরায়ুকে একটি আসন্ন গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করা। সাধারণত মাসিক চক্রের ১৪তম দিনে কিছু হরমোনের সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে ডিম্বাশয় এর ভেতর ডিম্বাণুর পরিস্ফুটন ঘটে। সাধারণত একসাথে ২০ থেকে ৩০টি ডিম্বাণু পরিস্ফুটনের জন্য তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত মাত্র একটি ডিম্বাণুর পরিস্ফুটন ঘটে, বাকিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। স্ফুটনের দুই-তিন দিনের মধ্যে ডিম্ব শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হলে, জরায়ুর নবগঠিত স্তরের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে এবং স্তরটি অনিষিক্ত ডিম্বাণু সহ মিশ্রিত রক্তের সঙ্গে বের হয়ে যায়। এটা সাধারণত মাসিকের ২৮তম দিনে ঘটে এবং এটাকেই মাসিক নামে সবাই জানে। যাইহোক, পরিপূর্ণ পরিস্ফুটিত ডিম্বটি ডিম্বাশয় থেকে বের হওয়ার পর জরায়ুর সাথে সংযুক্ত টিউবে (ঋধষষড়ঢ়রধহ ঃঁনব) প্রবেশ করে। টিউবের শেষ প্রান্তে ডিম্বটি শুক্রাণুর জন্য দুই-একদিন অপেক্ষা করতে থাকে। ডিম স্ফুটনের এই পুরো সময়টুকুতেই মহিলাদের ভিতরে এক ধরনের যৌনতাড়না থাকে, উত্তাপ থাকে এবং যৌন নালীতে সাদা রঙের একধরনের বিশেষ স্রাব তৈরি হয়। যৌন মিলনের সময় পুরুষের শুক্রাণু মহিলাদের যৌনাঙ্গে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ শুক্রাণু এই স্রাবের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে, হামাগুঁড়ি দিয়ে একসাথে জরায়ুতে প্রবেশ করে। লাখো-কোটি শুক্রাণুর মধ্যে মাত্র একটি শক্তিশালী শুক্রাণু এ প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করে এবং জরায়ু হয়ে ফেলোপিয়ান টিউব এর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয় এবং অপেক্ষারত ডিম্বাণুকে নিষিদ্ধ করে। এটাই জীবন সৃষ্টির প্রথম উৎসব বা অভিষেক। এখানেই তৈরি হয় জাইগোট (তুমড়ঃব) যা প্রাথমিক ভ্রূণ। এ ভ্রূণ ধীরে ধীরে জরায়ুর দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব থেকে প্রস্তুত জরায়ুর একটি দেয়ালে আবাস গড়ে তোলে। ভ্রূণের বিকাশ নয় মাস ধরে এখানেই ঘটে এবং একটি ছোট্ট মানব শিশু জন্মের জন্য তৈরি হয়।
এখন রোগীদের প্রশ্নের ব্যাপারে আসি।
স্ত্রীর মাসিকের কোন দিনগুলোতে মেলামেশা করলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
১৪তম দিনে যেহেতু ডিম্ব স্ফুটন ঘটে, তাই এর দু’দিন আগে এবং দু’দিন পর পর্যন্ত অর্থাৎ মাসিক চক্রের ১২তম দিন থেকে ১৬তম দিন পর্যন্ত সময়টুকু সন্তান উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়।
সাধারণত অনেকেরই ভুল বিশ্বাস রয়েছে। কিছু লোক মনে করে যে কোনো দিন মেলামেশা করলেই সন্তান হয়। আবার কিছু লোক মনে করেন মাসিক চলাকালীন সময়ে স্ত্রী সহবাস করলে সন্তান হয়। আবার কোনো কোনো রোগী সহবাসের সময়ে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি বা আসনের কথা বলেন। ভুল, এগুলো সবই ভুল।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ), জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চেম্বার-১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন-০১৭১২-২৯১৮৮৭
