ডা. কবিরাজ নীহার রঞ্জন দত্ত :
শরৎকাল এলেই বাঙালি মাত্রেরই মনে একটা পুলক সৃষ্টি হয় দুর্গাপূজা এলো বুঝি? এই পুলকই তাকে দুর্গাপূজার বিভিন্ন ক্রিয়া-কলাপ, আচার-আচরণ, কেনা-কাটা ইত্যাদির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর যারা পূজার সঙ্গে সরাসরি জড়িত তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় পূজায় যে সকল উপকরণ লাগে তার কোন কোনটি কোথায় পাওয়া যায়, কিভাবে ব্যবস্থা করতে হবে, তার লিস্ট কোথায় পাওয়া যাবে এ সকল কথা। পূর্বে দুর্গাপূজা রাজ-রাজাদের বা ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের একক পূজা ছিল। বর্তমান ভোগবাদী সমাজে একক চেষ্টায় এত বড় অনুষ্ঠান, এত অর্থ ব্যয়, এত দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না তাই রূপ নিয়েছে সর্বজনীন পূজার। মায়ের পূজার কল্পারম্ভ থেকে দশমী পূজা পর্যন্ত পূজার উপকরণ হিসেবে যে সকল দ্রব্যের প্রয়োজন হয় তা আমরা অনেকেই জানি না বা জানার চেষ্টাও করি না। পুরোহিত মহাশয় তাঁর ছেড়া-ফাঁড়া কাগজের টুকরা খোঁজে (যেটি তার পূর্ব-পুরুষের কারো হাতে লেখা) তা দেখে লিস্ট তৈরি করে দেন, আর আমরা সংগ্রহ করতে নামি পূজার উপকরণ। এসকল উপকরণের অধিকাংশই আমরা সঠিক চিনি না বা যোগের বিবর্তনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। আবার স্থানীয়ভাবে নামকরণ এর কারণে এক এক এলাকার মানুষ এক এক নামে চিনে তাই খুঁজে বের করাও সহজ নয়। তাই আজ প্রয়োজন হয়ে পড়ছে সর্বজনস্বীকৃত একটি পরিচিত নাম। এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমি চেষ্টা করছি ওই সকল দ্রব্যের সর্বজনস্বীকৃত বোটানিক্যাল অথবা ইংরেজি নাম আমাদের প্রচলিত বাংলা নামের পাশাপাশি উপস্থাপন করতে-নি¤েœ দ্রব্যসমূহের বাংলা নামের পাশাপাশি বোটানিক্যাল নামের একটি তালিকা দেয়া হল : সিন্দুর। পঞ্চগুড়িকাসাদাবর্ণ গুড়িকা, আতপ চাউল চূর্ণ রক্তবর্ণ গুড়িকা-কুসুম ফুল চূর্ণ সিন্দুর (অভাবে) পিতবর্ণ গুড়িকা-হরিদ্রাচূর্ণ সবুজ বর্ণ গুড়িকা-বিল্মপত্র চূর্ণ কালবর্ণ গুড়িকা-শস্যহীন দগ্ধ ধান্য চূর্ণ পঞ্চ পল্লব আম শাখা বট পাকুড়।
পঞ্চ শস্য শালি ধান, যব, শ্বেত সরিষা, মুগ, তিল অথবা মাষকলাই পঞ্চ রতœ – মনি-মানিক্য বা চুনী (মূল্যবান পাথর) মুক্তা (ঝিনুক ইত্যাদির মধ্যে পাওয়া যায়। প্রবাল (এক প্রকার সামুদ্রিক কীট এর বাসা) স্বর্ণ (মূল্যবান ধাতব পদার্থ) রৌপ্য (ধাতব পদার্থ) পঞ্চচাব্য গোমূত্র, গোময়, দধি, দুগ্ধ ও ঘৃত । পঞ্চ অমৃত-দধি, দুগ্ধ, ঘৃত মধু ও চিনি বা শর্করা পঞ্চ কষায় জামছাল শিমূল ছাল/শালমলি বেড়েলা ছাল বকুল কুল/বদরী/বরই ছাল। সবৌষধি-মুরামাংসীএকাঙ্গি, মুরা, গন্ধকুটী, সুরভি নামে পরিচিত বচ, ফুড়, শৈলেয়/শৈলজ, হরিদ্রা, দারু হরিদ্রা।
নব পত্রিকা-কলাগাছ কাল কচুগাছ হলুদ গাছ জয়ন্তী/নাদেয়ী শাখা বেল ডাল ডালিমডাল অশোক ডাল মানকচু গাছ ধানগাছ এবং বন্ধনদ্রব্য শ্বেত অপরাজিতা লতা এই সংগে ডালসহ যুগ্ম বেল মহাস্নান এর দ্রব্যাদি হলুদ, পঞ্চকষায়, ইক্ষুরস বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা বা বারবর্নিতাদ্বার মৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকা, বরাহ দন্ত মৃত্তিকা, চতুষ্পথ মৃত্তিকা, রাজদ্বার মৃত্তিকা, গঙ্গা-মৃত্তিকা, বল্মীক মৃত্তিকা নদীর উভয়কুল মৃত্তিকা, পর্বত মৃত্তিকা, বিষ্ণু তৈল, নারিকেলের জল সবৌষধি, মহৌষধ, শুঠ, পঞ্চরতœ মিশ্রিত জল, সাগরজল, কম পদ্মরেণুক, দুধ, মধু, কু, অগুরু, চন্দন শ্বেত চন্দন রক্ত চন্দন, কুঙ্কুম, বৃষ্টিজল, ফলের জল (ফলোদক), সরস্বতী ন জল, সপ্তসমুদ্রের জল ও জবাফুল !
পড়ষহ, ভড়স, হরীতকী দুর্বা, ধান কুশ, পান, তুলসী, সিদ্ধি। তাহা ছাড়াও আরও অনেক দ্রব্য স্থানের স্বল্প কারণে এখানে দেয়া সম্ভব হলো না। এ সকল উপকরণ কেন পূজার অংগিভুত হয়েছে। বর্তমান বাস্তববাদীর যোগে অনেকেরই প্রশ্ন। এ প্রশ্ন মীমাংসার প্রয়োজন। এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি দ্রব্যই মানব বা অন্যা প্রাণীকুলের মঙ্গলের জন্য কোনো না কোনভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে চরকিয় যোগের আঘ থেকে। (ভৈষজ্য) তরে দিক থেকে বিচার করলে এদের প্রায় প্রতিটিরই ঔষধি। রয়েছে। এই ক্ষুদ্র পরিসরে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওই দ্রব্রসমূহের পৃথক পৃথক দ্রব্যগুণ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। অথর্ববেদ, চরক সংহতা, সুশ্রুত সুহিং দ্রব্যগুণ, ভৈষজ্য রতœাবলী, চিরঞ্জীব বনৌষধি, ভার বনৌষধি, গেন্ডাসারি অব ইন্ডিয়া, ওয়েন্থ অব ইন্ডিয়া ইত্য গ্রন্থসমূহে এ সকল দ্রব্যের গুণ ও ব্যবহার বিশদভা বর্ণনা আছে। দুর্গা পূজায় ব্যবহৃত প্রায় শতাধিক দ্রব্যের গুণ ও ব্যবহার সঠিকভাবে জানা থাকলে একজন মানুষের জীবনে চলার পথে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যিনি এই শতাধিক দ্রব্যের সঠিক গুণ ও ব্যবহার জানবেন তিনি একজন ডাক্তার দেশীয় ভেষজ বিজ্ঞানীরূপে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন। কারণ এ সকল ভেষজকে ব্যবহার করতে পারলে, আমাদের সমাজের লোকদের সকল রোগ হয় তার অধিকাংশই নিরাময় করা বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
সিন্থেটিক ঔষধ আজ সারা পৃথিবীর জীবকূলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা পত্র-পত্রিকা পড়লেই বুঝা যায়। এ হুমকির মোকাবিলা করতে হলে পুনরায় আমাদেরকে প্রাচীনদের দেয়া জ্ঞান এর ওপর নির্ভর করতে হয়। মার্ক-েয় পুরাণোক্ত সুরথ রাজার কাল থেকে দুর্গা পূজায় যেসকল দ্রব্যের ব্যবহার হয়ে আসছে তা হয়ত বৎসরান্তে হলেও একবার ওই সকল প্রয়োজনীয় ভেষজের স্মরণ, মনন, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণেরই একটি কৌশল মাত্র। কৌশলটি অতি সুক্ষ্মভাবে সমাজপতিগণ আমাদের সমাজে ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন বলে তারা আমাদের নমস্য। তারা যদি এরূপ বিভিন্ন ব্যবস্থা না করতেন তা হলে এতদিনে হয়ত অনেক প্রয়োজনীয় ভেষজ পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যেত এবং প্রকৃতির জন্য হতো অত্যন্ত ভয়াবহ। এমন সব দ্রব্য দুর্গাপূজার উপকরণে আছে যা জীবানুধংসী পরিবেশ রক্ষায় উপযোগী, স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ প্রয়োজন, রোগনাশক, রসায়ন এবং জীবনী শক্তিবর্ধক। তাই আজ আমাদের প্রয়োজন পরিবেশকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার জন্য ধর্মীয় রীতিনীতিকে মেনে চলা এবং প্রাচীনের ঐতিহ্যকে রক্ষা করা।