দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ আদানি গ্রুপের ‘কেলেঙ্কারি’ ভারতীয় পুঁজিবাদের জন্য চরম পরীক্ষা

0
14

একটি ‘করপোরেট দানব’ আকারে ছোট হতে মাত্র সাতদিনের একটু বেশি সময় লেগেছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও গৌতম আদানি বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি এবং ভারতের স্বঘোষিত ‘রকফেলার’ ছিলেন। সম্প্রতি গৌতম আদানির গ্রুপের শেয়ারবাজার ‘কেলেঙ্কারি’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে যান। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার ১০০ বিলিয়ন ডলার খোয়া যায়। এই টাইকুনের ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে কোটি কোটি টাকা সরানো হয়েছে। এখন কোম্পানিটি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এবং বলছে ঋণ পরিশোধ করতে পারে তারা।
শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি আদানির ‘ফারাওবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও আদানির ‘ঘনিষ্ঠ’ সহযোগী নরেন্দ্র মোদীর জন্যও রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় পুঁজিবাদকে কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে এই শেয়ার কেলেঙ্কারি।
আদানির বিশাল সাম্রাজ্য লাখ লাখ ভারতীয়র দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব ফেলছে। আদানি গ্রুপের মোট সম্পদ ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তার মধ্যে সবুজ জ্বালানি, বন্দর, খনি, বিমানবন্দর ও বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পও তাদের হাতে। ভারতের বড় বড় কয়েকটি বন্দর, কৃষিখাতে বিনিয়োগ, পাওয়ার-ট্রান্সমিশন লাইনের পঞ্চমাংশ এবং সিমেন্টের এক-পঞ্চমাংশও পরিচালনা করে এই আদানি গ্রুপ। এটি সম্পদের দিক থেকে ভারতের শীর্ষ ১০টি বৃহত্তম সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমানও করা হয়।
সেই বৃদ্ধির সম্ভাবনা এখন অনিশ্চিত। গৌতম আদানির করপোরেট সাম্রাজ্যের তথ্য অন্যভাবে সম্প্রতি তুলে ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ। গত ২৪ জানুয়ারি সংস্থাটি বিশ্বের অন্যতম ধনী, টাইকুন আদানির প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্টক ম্যানিপুলেশন ও জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। যদিও আদানি গ্রুপ বলছে, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন এবং একটি দীর্ঘ যুক্তি খণ্ডন রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা। তবে এ ঘটনার ফলে আদানি গ্রুপের শেয়ারের দাম কমেছে এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে।
ভারতের মোদী সরকারের পরিকাঠামোতে পুঁজি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনায় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আদানির গ্রুপ উল্লেখযোগ্য। মোদীর সঙ্গে আদানির সম্পর্ক কয়েক দশক আগে গুজরাটে গড়ে ওঠে। যে রাজ্যে রাজনীতিবিদ মোদী ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং যেখানে আদানি টাইকুন তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি আদানির প্লেনে চড়েই দিল্লিতে যান। তখন থেকে বর্তমান, হিনডেনবার্গের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের মাঝে, আদানির ব্যক্তিগত সম্পদ ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২০ বিলিয়নে পৌঁছেছিল।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ‘আদানিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিতে প্রলুব্ধ হতে পারে মোদী সরকার। কিন্তু এটা একটা ভুল হবে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য ভারতের অনেক শর্তও রয়েছে। যদি সম্ভাবনা অর্জন করতে হয়, তবে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা যাচাই-বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ।’
ভারতে যারা ঘুরতে যান তারা জানেন রাস্তা, সেতু ও বিদ্যুতের জন্য সেখানকার মানুষ মরিয়া। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের আগের বছরগুলোতে অবকাঠামোতে বিশাল বিনিয়োগ উৎসাহিত করেছিল দেশটির সরকার। কিন্তু বর্তমানে খরচ বেড়েছে। খুব কম প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ব্যাংকগুলোও মন্দ ঋণে জর্জরিত ছিল এবং প্রবৃদ্ধিও ছিটকে পড়েছিল।
একটি শক্তিশালী শিল্পনীতি মোদী সরকারের জন্য লোভনীয় ব্যাপার। তিনি ভারতকে একটি বৈশ্বিক উৎপাদনের পাওয়ার হাউজ বানাতে চান। ভালো রাস্তা ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে এবং স্থানীয় সরবরাহ শৃঙ্খল বিকাশে সহায়তার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে। আদানি, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা এবং জেএসডব্লিউসহ ভারতের কিছু বড় কোম্পানি, অবকাঠামো ও উদীয়মান শিল্পে আগামী পাঁচ থেকে আট বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। স্যামসাং ও ফক্সকনসহ ভারতে উৎপাদন সম্প্রসারণকারী বিদেশি সংস্থাগুলোকেও ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সে লক্ষ্যে।
বিনিয়োগকারীদের বাছাই করার কৌশল সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সরকারের জন্য। তবে আদানির দুর্দশা কী ভুল হতে পারে তার একটি সতর্ক হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করে। লাইসেন্স ত্বরান্বিত করার নীতিও পক্ষপাতিত্বের কারণে বিনষ্ট হতে পারে। আরেকটি বিপদ হলো, যে বিনিয়োগকারীকে বেছে নিয়েছেন তিনি বা তারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেন না। আদানি গ্রুপ বলছে, তাদের সব প্রকল্প সম্পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট অর্থ রয়েছে। কিন্তু এটির জ্বালানি সম্প্রসারণের মডেল এখন নিশ্চয়ই অনিশ্চিত।
টাইকুন যত বড় হয়, তত বড় বাজি ধরা হয়ে যায়। ভারতের ৫০০টি বৃহত্তম অলাভজনক সংস্থাগুলোর মূলধন বিনিয়োগের ৭ শতাংশের জন্য আদানি গ্রুপ একাই দায়ী। তিনি দেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর প্রভাবশালী অপারেটরও। তার ফার্ম মুম্বাইতে একটি নতুন বিমানবন্দর ও গুজরাটের স্টিল মিলের মতো প্রতিষ্ঠানে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এখন অবধি প্রধানমন্ত্রী মোদী আদানির পরিস্থিতি সম্পর্কে নীরব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশটিতে যথেষ্ট জনপ্রিয়। যদিও বিরোধী কংগ্রেস দল দ্বারা সংগঠিত কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি চোখে পড়ছে। নাটকীয়তা থাকলেও রাজনৈতিক ফল সহজে বদলাবে না। দেশটির মন্ত্রীরা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলো সঠিক রয়েছে। কিন্তু ব্যবসা করার জন্য ভারত যে একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা তা দেখানোর জন্য তাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। সেটির দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হলে ভারতের বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন হবে। যদিও বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলো এমন দেশে প্রবেশের জন্য সতর্ক হয়ে উঠেছে যেখানে শাসনব্যবস্থা টেকসই নয়।
বলা হচ্ছে, সরকার তার পক্ষপাতিত্বের ওপর লাগাম টানা শুরু করতে পারে এবং বড় বড় ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করতে পারে। যদি নিউইয়র্কের একটি ছোট ফার্ম কঠিন প্রশ্ন করে, তাহলে নিয়ন্ত্রকরা কেন করেনি এতোদিন? হিনডেনবার্গের অভিযোগ, ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড ২০২১ সালে আদানি সম্পর্কে তদন্ত শুরু করেছিল, তবে পরে তা থেমে যায়। সংস্থাটির আদানি সম্পর্কে চলমান তদন্তের অবস্থা ঘোষণা করা উচিত। মরিশাসভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর থেকেও স্বচ্ছতার দাবি করা উচিত, যা প্রায়শই ভারতীয় স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। যদিও আদানি ৪১৩ পৃষ্ঠার যুক্তি খণ্ডন করেছেন।
হিনডেনবার্গের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেশটির গণমাধ্যমগুলো আদানি ইস্যু নিয়ে ততটা সক্রিয় নয় বলে অভিযোগ আছে। আদানি নিজেই সম্প্রতি ভারতীয় সম্প্রচার মাধ্যম এনডিটিভি কিনে নিয়েছেন। অথচ এই গণমাধ্যমটি একসময় সরকারের সমালোচনায় সরব ছিল কিন্তু এখন নীরব।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ভারতীয়রা বিদ্যুৎ ও রাস্তা থেকে নিশ্চয়ই উপকৃত হবে। কিন্তু তাদের আরও প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন শাসন ব্যবস্থা।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট