ড. হারুন রশীদ
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ ও উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের। দুঃখগ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেওয়ার দিনও এটি।
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি,যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালির যে কয়টি উৎসব আছে তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি বয়সের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জ তো বটেই নাগরিক জীবনেও জায়গা করে নিয়েছে এই উৎসব।
রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরে সঙ্গীতে বর্ষবরণের আয়োজন, চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই এক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।
নানা রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সব বয়সী মানুষজন অংশ নেয় এই উৎসবে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। থাকে পান্তা ইলিশ খাওয়ার আয়োজন। সবমিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উৎসবে মাতে এদিন পুরো বাঙালি জাতি।
বৈশাখে এখন কেনাকাটার ধুমও পড়ে যায়। সরকার বৈশাখী ভাতাও চালু করেছে উৎসবের গুরুত্ব বিবেচনায়। এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে উৎসবে। এছাড়া বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
‘বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষের ১০ কিংবা ১১ মার্চ তারিখে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে তারিখ-এ-এলাহী প্রবর্তন করেন। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে।
এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজিকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব প্রদান করেন। বিখ্যাত পণ্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর হয় সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান।
চন্দ্র বছরের হিসাবেই তখন কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হতো অথচ চাষবাসনির্ভর করতো সৌর বছরের হিসাবের ওপর। চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সেখানে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।’ (সূত্র: উইকি পিডিয়া)
সারাবিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কর্মকাণ্ডের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে। তারপরও বাঙালির গভীর মানসে বাংলা নববর্ষের স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙালির মনপ্রাণজুড়ে রয়েছে বাংলা নববর্ষ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতি, কামার-কুমারসহ নানা পেশার মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে আনন্দ উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে।ব্যবসায়ীরা এখনও হিসাবের নতুন খাতা ‘হালখাতা’ খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে। এজন্য মিষ্টান্নেরও আয়োজন থাকে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশে গ্রামগঞ্জে নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে।
এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা সনের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত এই দেশের মানুষের জীবনধারা এবং প্রকৃতির অবস্থার সঙ্গে ফসলের মৌসুম এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন তারিখ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন হলেও এ নববর্ষ উৎসব বাঙালির চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা এমন একটা উৎসব যাকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীসহ সবাই সর্বজনীনভাবে প্রাণের আনন্দে বরণ করে নেয়।
দুই বছর করোনায় বন্দি থাকার পর এবার বৈশাখ ফিরছে পূর্ণরূপে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হবে সূর্যরাঙা বৈশাখের। যুক্ত হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতাও। এবার রমজান মাস চলায় বৈশাখের আয়োজনেও থাকবে ভিন্নতা।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ এবং উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের। দুঃখগ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেওয়ার দিনও এটি।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় সিক্ত হতে হবে। সব বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধ উজিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সব কলুষতা। এবারের বৈশাখে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটুক।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর,
