Saturday, September 23, 2023
Homeসাহিত্যবায়ান্নর রাজরোষে পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী

বায়ান্নর রাজরোষে পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী

Published on

সাম্প্রতিক সংবাদ

উদ্যোগ নেয়া হোক কার্যকরী

বাংলাদেশ এখনো রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের আশা রাখছে। রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন বহন করার মতো...

নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারী বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

প্রতিদিনের ডেস্ক ধারণা করা হচ্ছিল, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু...

ধানক্ষেতে পোকার আক্রমণ: যা বিষেও মরছে না, দিশেহারা কৃষক

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি আমন ধান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কৃষকরা। তবে এবার...

চৌগাছায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দ্বিতল ভবন, দূর্ঘটনার আশংকা

চৌগাছা সংবাদদাতা যশোরের চৌগাছা বাজারে জরাজীর্ণ একটি দ্বিতল ভবন চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পৌর কর্তৃপক্ষ...

এম আবদুল আলীম
ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের সামনে আসে বায়ান্নর সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা; আসে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে রাজপথ প্রকম্পিত করা-প্রসঙ্গ, আসে শহিদদের আত্মত্যাগ এবং অগণিত মানুষের জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহের কথা। আজ আমরা এখানে তুলে ধরবো বায়ান্নর সেই অগ্নিঝরা দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তীর গ্রেফতার, কারানির্যাতন ভোগ, চাকুরি থেকে বিতাড়িত হওয়া এবং দেশত্যাগের মতো বেদনাত্মক ও করুণ ট্র্যাজেডির কথা।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর মুসলিম লীগ সরকার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মের জিকির তুলে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর খড়্গহস্ত হয়। তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে অপপ্রয়াস শুরু করে। অবশ্য দেশভাগের আগে থেকেই কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দিকে হবু রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে থাকেন। প্রতিবাদে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই লেখনী ধারণ করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এমন বাদানুবাদের মধ্যেই দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকার দাপ্তরিক কাজে; বিশেষত ডাকটিকেট, মুদ্রা, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বিষয় প্রভৃতি থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া শুরু করে। এদিকে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষাবিষয়ক সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলে পূর্ববঙ্গের রাজপথে প্রত্যক্ষ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন দমনে সরকার প্রথম থেকেই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মামলা-হামলার পাশাপাশি চলে গ্রেফতার ও কারানির্যাতন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি ছাত্র, যুবক এবং বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার ও কারানির্যাতন করা হয়। এর ফলে কারো শিক্ষাজীবন, কারো দাম্পত্যজীবন, কারো চাকুরিজীবন, কারো রাজনৈতিক জীবন তছনছ হয়ে যায়। অগণিত মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়। অসহনীয় নির্যাতন এবং বিনা চিকিৎসায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কারো কারো জীবন হয় বিপন্ন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ; ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, এম এ ওয়াদুদ; মর্গ্যান স্কুলের প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, পৃত্থীশচন্দ্র চক্রবর্তী; পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকসহ অনেকের নাম রয়েছে এই কারানির্যাতিতদের তালিকায়। কারামুক্ত হলেও অনেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি; যেমন- শামসুল হক।
পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী গ্রেফতার হয়েছিলেন রাজরোষে। ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে জন-নিরাপত্তা আইনে তাঁকেসহ আরও গ্রেফতার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মুজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখকে। পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। তাঁর জন্ম সিলেটে। দেশভাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেও তিনি জন্মভূমির টানে পূর্ববঙ্গেই থেকে যন। কিন্তু তাঁর সে ভালোবাসার মূল্য দেয়নি জুলুমবাজ মুসলিম লীগ সরকার। ১৯৫১ সালে একবার বানোয়াট অভিযোগ তুলে তাঁকে হয়রানি করা হয়। ওই সময় তিনি প্রতিহিংসার শিকার হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিয়োগ দিলে একটি কুচক্রীমহল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং দেশদ্রোহিতাসহ নানা অভিযোগ উত্থাপন করে। সে যাত্রা রক্ষা পেলেও ১৯৫২ সালে রেহাই পাননি। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তা দমনে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহ, আউয়ালসহ অনেককে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয় অনেককে।
পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রকাশ্যে ভাষা-আন্দোলনের সভা-সমাবেশে যোগ না দিলেও এ আন্দোলনে তাঁর পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিলো। তাছাড়া রাজনৈতিক দিক থেকেও তিনি ছিলেন সচেতন। সে কারণে রাজরোষে পড়েন। জন-নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। এর মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িক চেহারা ও হিংস্র রূপের চরম প্রকাশ লক্ষ করা যায়। পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তীসহ অন্য শিক্ষকদের গ্রেফতার ও সরকারের সাম্প্রদায়িক আক্রোশ সম্পর্কে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন : ‘অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, ড. পিসি চক্রবর্তী এবং জগন্নাথ কলেজের অজিত গুহকে গতরাতে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। টের পাওয়া যাচ্ছে খুবই জোরেশোরে গ্রেফতার অভিযান চলবে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মিথ্যা কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। এবং কোনো কারণ ছাড়াই এ বিষয়ে হিন্দুদেরকে টেনে আনা হচ্ছে।’
আটকের পর সরকার তথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ওপর নির্মম আচরণ করে। ১৯৫২ সালের ১৫ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মার্চ মাসের শেষের দিকে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। জামিনে মুক্ত হলেও রাজরোষ থেকে মুক্তি পাননি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে এক পর্যায়ে দেশত্যাগ করেন। তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং একই বছর ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর একটি চিঠি লিখে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। সরকারের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়, যাতে তাঁকে কেন চাকুরিচ্যুত করা হবে না মর্মে কৈফিয়ত তলব করা হয়। জবাবে তিনি লেখেন, কাউকে জন-নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে গ্রেফতার করা হলেই সে দোষী হয় না। এও লেখেন, তিনি কোনোভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত নন।
এদিকে কৈফিত তলবের পূর্বেই পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী পদত্যাগ করায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জটিলতায় পড়েন এবং তা নিরসনে শিক্ষা সচিবের নিকট পরামর্শ চেয়ে পত্র লেখেন। অবশেষে সরকারের নির্দেশে ১৯৫২ সালের ১৬ই এপ্রিল থেকে তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। এভাবেই ভাষা-আন্দোলনের সময় গ্রেফতার ও বন্দি হওয়া অধ্যাপক পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তীর জীবনের এক করুণ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তী ঘটে। শেষজীবনে তিনি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
ভাষা-আন্দোলনের শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এ আন্দোলনে কমিউনিস্ট, হিন্দু ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ইন্ধন আছে বলেও প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয় এবং গুজব ছড়ায়। মুসলিম লীগের সাধারণ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন পর্যন্ত এ কাজে লিপ্ত হন। মুসলিম লীগ সরকারের এই হীনকর্মের অংশ হিসেবে অধ্যাপক পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তীর মতো কীর্তিজনের গ্রেফতার, কারানির্যাতন এবং দেশ ও চাকুরি থেকে বিতাড়নের মতো বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত জুলুমবাজ মুসলিম লীগ সরকার সফল হয়নি; বরং ব্যর্থ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ মূলে রয়েছে পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তীর মতো দেশপ্রেমিকদের ত্যাগ। রাজনীতির মঞ্চ থেকে মুসলিম লীগের করুণ বিদায় ঘটে মাত্র দু বছরের মধ্যে। শুধু তাই নয়, ভাষা-আন্দোলন এ অঞ্চলের মানুষের মনে যে চেতনাবোধ জাগ্রত করে, তা ক্রমে বিকশিত হয়ে পূর্ববঙ্গের মাটি থেকে পাকিস্তানি দুঃশাসনের কবর রচনা রচিত হয় এবং বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন বাংলাদেশ।

spot_img
spot_img

এধরণের সংবাদ আরো পড়ুন

তাওসিফ মাইমুনের কবিতা

আড়ি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হবে আমাদের আড়ি অবাক দৃশ্যে যতটা পথ দাও না পাড়ি বেলা ফুরালে ফিরবো না...

ধ্বংসের পথে ৫০০ বছরের ফকির বালেগশাহ মসজিদ

প্রতিদিনের ডেস্ক তিন গম্বুজ ‘ফকির বাল্লেগ শাহ্ মসজিদ’ মোগল আমলে নির্মিত ,প্রায় ৫০০ বছরের...

আমিরুল ইসলাম বাপনের কবিতা

মস্তকের বিস্ফোরণ এই সঙ্কুচিত পৃথিবীতে আমার মাথাটা রাখার জায়গা পাচ্ছি না, দয়াকরে আপনারা নিজস্ব অবস্থানে থাকুন। শীতের...