সুন্দর সাহা :
যশোরের শার্শা- বেনাপোল এবং চৌগাছা সীমান্তের পর এবার ঝিকরগাছা সীমান্ত ব্যবহার করছে সোনা পাচারকারীরা। এসব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে সোনার বার ভারতে পাচার করছে চিহ্নিত চোরাকারবারিরা। একের পর এক বিজিবির অভিযানে বিপুল পরিমাণ সোনার বার উদ্ধার হলেও অদৃশ্য কারণে পুলিশি নিস্ক্রিয়তায় সিন্ডিকেকেটের হোতারা থেকে যাচ্ছে অধরা। যা নিয়ে সীমান্তবাসীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী এবং খুলনা-২১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান (পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স)-এর নেতৃত্বে সোনা পাচার রুখতে বিজিবির অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা মঙ্গলবার বিকেলে ঝিকরগাছা উপজেলার ব্যাঙদা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভারতে পাচারের সময় ১০৬ পিস সোনার বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করেছেন। আটক পাচারকারী চৌগাছা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের সালামের ছেলে সাজু আহমেদ। উদ্ধার হওয়া উদ্ধারকৃত সোনার ওজন সাড়ে ১২ কেজি। যার বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী জানান, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের ব্যাঙদা সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনার চালান পাচার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। এমন সংবাদ পেয়ে সেখানে তারা অভিযান চালিয়ে পাচারকারী সাজুকে আটকের পর তার শরীরে বিভিন্নভাবে সেট করা অবস্থায় ১০৬টি সোনার বার উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত সোনার মূল্য ১০ কোটি টাকা বলে জানান বিজিবির অধিনায়ক। আটক হওয়া সাজুকের ঝিকরগাছা থানায় সোর্পদ করা হয়েছে। এর আগে ভারতে পাচারের সময় বেনাপোল সীমান্তে বেনাপোল-ঢাকাগামী এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে ১০টি সোনার বারসহ অনিক কুমার বিশ্বাস (৩০) নামে এক পাচারকারীকে আটক করেছেন যশোর-৪৯ব্যাটালিয়ন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। যার ওজন এক কেজি ১৬৫ গ্রাম। উদ্ধারকৃত সোনার মূল্য ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। ১৭ অক্টোবর বেনাপোলের রেলস্টেশন এলাকা থেকে ওই সোনাসহ তাকে আটক করা হয়। সে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান বিক্রমপুর এলাকার মৃত বিমলেন্দু বিশ্বাসের ছেলে। যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী দৈনিক প্রতিদিনের কথাকে এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
খুলনা-২১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা এর কয়েকদিন আগে অভিযান চালিয়ে শার্শা সীমান্তের অগ্রভূলাটের ৮৮ নম্বর পিলার এলাকায় সীমান্তের আনুমানিক ১০০ গজ দূরে অভিযান চালান। এসময় তিনজন সোনার বার নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল। বিজিবি ৪৩ পিস সোনার বার উদ্ধার করলেও পাচারকারীরা পালিয়ে যায় বলে বিজিবি সূত্র জানায়। যারা পালিয়ে গেছে তাদের দুজন হচ্ছে মো. আব্দুল্লাহ ও রিপন। অন্য জনের নাম জানা যায়নি। শার্শার ৬টি ঘাটের মধ্যে বর্তমানে অগ্রভূলাট সোনা পাচারের সবচেয়ে আলোচিত ঘাট হিসেবে পরিচিত। উদ্ধারকৃত ৪৩ পিস সোনার বারের ওজন ৫ কেজি ১৪ গ্রাম এবং যার মূল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বলে দৈনিক প্রতিদিনের কথাকে নিশ্চিত করেন খুলনা-২১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান (পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স)। এরও আগে খুলনা-২১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা শার্শা সীমান্তের মহিষাকুড়া থেকে ২ কোটি টাকা মূল্যের ২০টি সোনার বারসহ হৃদয় হোসেন (২৫) নামের এক যুবককে গত শনিবার গ্রেফতার করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যরা। মহিষাকুড়া সড়কের ওপর থেকে সোনার বারসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হৃদয় হোসেন বেনাপোল পোর্ট থানার কাগজপুকুর গ্রামের ভ্যানচালক রেজাউল ইসলামের ছেলে। বিষয়টি দৈনিক প্রতিদিনের কথাকে নিশ্চিত করেন খুলনা-২১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান (পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স)। শনিবার যে চালান আটক হয়েছে, এসব সোনা আনা হচ্ছিল ঢাকার আওলাদের কাছ থেকে। পুটখালী সীমান্তের সোনা পাচারকারী আরেক ডন আলমগীর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই সোনা আনা হয়েছে। এই সোনার গন্তব্য সীমান্তের ওপারের বস গৌতমের ডেরা। আলমগীরের সাথে রয়েছে জিয়া-রেজাসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্র। শনিবার-২১ বর্ডার গার্ডের অধিনায়ক সংগীয় ফোর্স নিয়ে শার্শা সীমান্তের মহিষাকুড়া সড়কে অভিযানকালে সন্দেহভাজন ওই যুবকের হাতে থাকা একটি শপিং ব্যাগসহ তাকে গ্রেফতার করে। পরে ব্যাগ তল্লাশি করে ২০টি সোনার বার পাওয়া যায়। যার ওজন ২ কেজি ৩৩৩ গ্রাম। এর বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। যা নিশ্চিত করেছেন, খুলনা-২১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান (পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স)। এদিকে, চৌগাছা সীমান্তের ওপারে গত ১০ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত চারদিনে তিন দফায় চৌগাছার কাবিলপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বাগদা সীমান্ত থেকে আটক প্রায় ১৫ কেজি সোনার বার। এসব সোনার ভারতীয় মূল্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি রুপি। বাংলাদেশে যার মূল্য প্রায় ১১ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, যশোর জেলার শার্শা-বেনাপোল- চৌগাছা ও ঝিকরগাছার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা ভারতে পাচার হচ্ছে। ভারত সীমান্তের বহুল আলোচিত আন্তর্জাতিক সোনাপাচারকারী বস্ গৌতম, শীর্ষ সোনা পাচারকারী অপু সাহা আর মাফিয়া ডন ফর্সা নাসির হচ্ছে এই রাজ্যের ভারতের ওপারের আলোচিত কিং। এসব সিন্ডিকেটে বাংলাদেশ থেকে সোনার বারের যোগানদাতা হিসেবে সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখে ঢাকার আওলাদ এবং চট্টগ্রামের ভোলা। যার পরেই রয়েছে, ঢাকার আরিফ-ইমরান-রাম সিন্ডিকেট। এদের নেপথ্যে অনেক হোমরাচোমরা রয়েছে। যাদের মধ্যে আছে শার্শা, ঝিকরগাছা এবং চৌগাছা উপজেলার বেশ কয়েকজন নেতা ও সাবেক এবং বর্তমান জনপ্রতিনিধি। এছাড়া, ঢাকায় অবস্থানরত একজন প্রকৌশলীর সাথেও এই চক্রের রয়েছে বেজায় দহরম-মহরম। শার্শার একজন শীর্ষ জনপ্রতিনিধি এই চক্রের গডফাদার বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সোনা এই চার থানার যেখানেই ধরা পড়–ক তার স্থানীয় এজেন্টের বাড়ি শার্শায় বলে জানা গেছে।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, ভারত সীমান্তের শীর্ষ সোনা পাচারকারী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণকর্তা বস্ গৌতম, অপু সাহা আর ফর্সা নাসির। যশোর জেলার বিভিন্ন সীমান্তের ওপারে সোনা পাচারের এই রাজ্যের এরাই রাজা। আলোচিত বস্ গৌতম হচ্ছে পুরাতন বনগাঁ এলাকার ডন। তার সিন্ডিকেট হচ্ছে, বোনাপোল ও শার্শার ২০টি অবৈধ ঘাট। বস্ গৌতমকে হিস্যা দিয়ে তার সিন্ডিকেট দিয়ে প্রতিদিন অপু সাহার অন্তত ৫শ গাড়ি সোনার বার ভারতে পাচার হয়। অপু সাহার বাড়ি ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বাগদা এলাকায়। শার্শার উত্তরাংশ এবং চৌগাছা বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়া সোনা বার যায় বাগদা সিন্ডিকেটের এক অংশের প্রধান বিতর্কিত অপু সাহা সিন্ডিকেট এবং আরেক অংশের প্রধান নাসির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এসব সিন্ডিকেটের সব সোনা পাচার করে অপু সাহা ও ফর্সা নাসিরের ঘাড়ে শওয়ার হয়ে বস্ গৌতম দেদারসে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এরা সব ঘাট ম্যানেজ করেই সোনা পাচারের ব্যবসা করে বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। চৌগাছার সীমান্তে এলাকায় বাড়ি ঢাকায় কর্মরত একজন প্রকৌশলীও এই চক্রকে সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরাসরি ফেনসিডিল পাচার এবং ঢাকায় বিকিকিনি ব্যবসার সাথেও এই প্রকৌশলী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। গত চারদিনে তিন দফায় চৌগাছার কাবিলপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বাগদা সীমান্ত থেকে প্রায় ১৫ কেজি সোনার বার উদ্ধার হলেও এপারে কেন ধরা পড়ছে না সীমান্তবাসীর কাছে এটায় এখন বড় প্রশ্ন।
সূত্রগুলো জানায় এপাশে বিজিবি এবং ওপাশে ভারতে বিএসএফ-এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। একের পর এক বিজিবির অভিযানে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ সোনার বার উদ্ধার হচ্ছে। একইভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের অভিযানেও উদ্ধার হচ্ছে। উদ্ধার হচ্ছে না কেবল পুলিশের হাতে। অদৃশ্য কারণে পুলিশি নিস্ক্রিয়তায় সিন্ডিকেকেটের হোতারা থেকে যাচ্ছে অধরা। যা নিয়ে সীমান্তবাসীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সোনা পাচারের গডফাদাররা কেন ধরা পড়ে না এমন প্রশ্নের জবাবে যশোর ব্যাটালিয়ন (৪৯বিজিবি)-র সিও লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী দৈনিক প্রতিদিনের কথাকে জানান, ‘সমন্বিত উদ্যোগ নিলে গডফাদারদের আটক করা অসম্ভব হবে না। যার যার অবস্থান থেকে প্রকৃত অর্থে দায়িত্ব পালন করলে এক সময় গডফাদাররা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ সোনা পাচারের গডফাদাররা কেন ধরা পড়ে না এমন প্রশ্নের জবাবে খুলনা ব্যাটালিয়ন (২১ বিজিবি)-র সিও লে.কর্নেল তানভীর রহমান (পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স) দৈনিক প্রতিদিনের কথাকে জানান, ‘বর্ডার ম্যানেজমেন্টে যদি ইন্টারকানেকটিভিটি থাকে, যদি যার যার মত ইনফরমেশনটা শেয়ারিং করতে পারি তাহলে হয়তো পাচার কমানো যেতে পারে। আর সীমান্ত এলাকার মানুষকে সচেতন করতে পারলেই এই দুষ্টু লোকগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।’