রত্না মাহমুদা
শেষ পর্ব
তৎকালীন সময়ে মেয়েদের নাম পর্যন্ত কেউ জানতো না ।পর্দার মত করে নামকে পর্দানশীন করে রাখতো। “আমাদের ন্যায় আমাদের নামগুলি পর্যন্ত পর্দানশীনা।মেয়েদের নাম জানা যায়,কেবল তাহাদের বিবাহের কাবিন লিখিবার সময়।এক মস্ত জমিদারের তিন কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে হইতেছিল।মেয়েদের ডাকনাম বড় গেন্দলা,মেজো গেন্দলা এবং ছোট গেন্দলা-প্রকৃত নাম কেহই জানে না।” (পৃঃ৩৪)
মেয়েদের নাম ডাকা পর্যন্ত চরম অন্যায় ছিল। একমাত্র বিয়ের সময় কাবিননামায় নাম লিখে বিয়ে পড়াতো।বর্তমান সময়ে যে কোনো অফিশিয়াল ডকুমেন্টেসে মায়ের নাম আগে ব্যবহার করে।প্রকৃত মর্যাদার মূল উদঘাটন করেছেন এই প্রথিতযশা নারী সাহিত্যিক। “একবার এক চলন্ত ট্রেনে মেয়েমানুষদের কক্ষে একটা চোর উঠিল।চোর বহাল তবিয়তে একে একে প্রত্যেকের অলংকার খুলিয়া লইল;কিন্তু লজ্জায় জড়সড় লজ্জাবতী অবলা সরলা কুলবালাগণ কোনো বাধা দিলেন না।তাঁহারা সকলে ক্রমাগত ঘোমটা টানিতে থাকিলেন।তওবা! তওবা!কাঁহা সে মদ্দুয়া আ গয়া!বলিয়া কেহ কেহ বোরকার নেকাব টানিলেন।পরে চোর মহাশয় ট্রেনের এলার্মের শিকল টানিয়া গাড়ি থামাইয়া নির্বিঘ্নে নামিয়া গেলেন।”-(পৃঃ৩৯-৪০)
চোরকে অলংকার ছিনিয়ে নিতে দিলেন তবুও নিজের পর্দা রক্ষা করলেন।পর্দা নষ্ট হলে নারীর মহাপাপ হবে।কিন্তু চোরের চুরি পর্দার কাছে অতি নগন্য। কলকাতায় একবার দেড় বছরের বাচ্চার জ্বর উঠলো।কিন্তু তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য ডাক্তার দেখাতে রাজি নই তাঁর পরিবার।শিশু বাচ্চাকে পুরুষ ডাক্তার দেখলে ঘোর অন্যায় হবে।ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েদের ঘরের বাহির করা হবে!মহিলা ডাক্তার দেখাতে হবে। “এক বোরকাধারিণী বিবি হাতে একটা ব্যাগ সহ ট্রেন হইতে নামিয়াছেন।তাঁহাকে অন্যান্য আসবাব সহ এক জায়গায় দাঁড় করাইয়া তাঁহার স্বামী কার্যান্তরে গেলেন।কোন কারণ বশতঃ তাঁহার ফিরিয়া আসিতে কিছু বিলম্ব হইল।এদিকে বিবি সাহেবা দাঁড়াইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া এবং শরীরের দেখিয়া ক্রমে লোকের ভীড় হইল।লোকেরা দয়া করিয়া জিজ্ঞাসা করিল,আপনার সঙ্গের লোকের নাম নাম বলুন ত,আমরা তাঁহাকে ডাকিয়া আনি।তিনি একবার আকাশে সূর্যের দিকে ইসারা করেন আর একবার হাতের ব্যাগ তুলিয়া দেখান।ইহাতে উপস্থিত লোকেরা কিছু বুঝিতে না পারিয়া হাসিতে হট্টগোল বাধাইয়া দিল। কিছুক্ষণ পর এক ব্যক্তি হাঁপাইতে হাঁপাইতে সেখানে দৌড়াইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,কি হইয়াছে? ভিড় কেন?ঘটনা শুনিয়া তিনি হাসিয়া বলিলেন,’আমার নাম আফতাব বেগ।তাই আমার বিবি সূর্যের দিকে ইশারা করিয়া দেন আর হাতের বেগ(ব্যাগ দেখাইয়াছেন।”(পৃঃ৫২)
নারীরা বোবা। নারীর গলার স্বর কেউ শুনতে পারবে না।তাই তাঁরা পর্দার আড়াল থেকেই ইশারা -ইঙ্গিতে কথা বলতেন। সবশেষে বেগম রোকেয়া সবার উদ্দেশ্যে বলেন।নারীরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ।নারীদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।ঘর বন্দী থাকলে, পর্দার আড়ালে থাকলে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।জগতের যে পুরুষ সঙ্গীসহ অগ্রসর হয়েছেন তাঁরা সমাজের উন্নতির শ্রেষ্ঠ আসন দখল করেছেন।রোকেয়ার ভাষ্যমতে “ভরসা করি আমাদের সুযোগ্য ভগ্নীগণ এ বিষয়ে আলোচনা করিবেন।আন্দোলন নাকরিলেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবেন। নারীর মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারাকে জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে তিনি অবরোধ বাসিনী পাঠক মহলে উপস্থাপন করেছেন।
লেখক:-রত্না মাহমুদা
কবি ও গবেষক
বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
