সুন্দর সাহা
মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ পৃথিবীতে এসেছিলেন দেবী দুর্গা। সপরিবারে ছিলেন ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত। এ সময় বয়ে গেছে আনন্দের লহর। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হয় সেই আনন্দের। সেই থেকে শুরু হয় দেবীর আগমনের জন্য আরো একটি বছরের অপেক্ষা। তবে ভরসা এটুকুই, যাওয়ার সময় দেবী দিয়ে যান অভয় বার্তা। আগামী বছর আবার আসার আশ্বাস। সেই বিশ্বাসেই মঙ্গলবার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়েছেন ভক্তরা। ‘বাবার বাড়ি বেড়ানো’ শেষে তিনি ফিরে গেলেন স্বামীর ঘরে কৈলাসে। এরই মধ্য দিয়ে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসব। ভক্তদের আনন্দ অশ্রুতে সাঙ্গ হলো আনন্দ আয়োজন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি যেমন- কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেয়াই বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। সনাতন হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী দুর্গা যে কদিন পিতৃগৃহে ছিলেন, সানাই-কাসর আর ঢোলের বাদ্য সে কদিন ভক্তদের মনে ভক্তি আর আনন্দ মূর্ছনা দুই-ই জাগিয়েছে। বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় সকাল সাড়ে ৬টায়। অনুষ্ঠিত হয় দশমী বিহিত পূজা, পুষ্পাঞ্জলি। ষোড়শপ্রচার পূজার পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। সবশেষে দর্পণ বিসর্জনের সময় প্রতিমার সামনে হাড়িতে জল রেখে সেই জলের মধ্যে দেবীকে দেখে তার কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নেন ভক্তরা। মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রতিমা থেকে ঘটে এবং ঘট থেকে আবার ভক্তের হৃদয়ে ‘মাকে’ নিয়ে আসাকে বিসর্জন বলে। এছাড়া সধবা নারীর সিঁদুর খেলার আচারে মুখরিত ছিল প্রতিটি মণ্ডপ। বিকেলে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে সিঁদুর খেলা আর আনন্দ, উৎসব। দেবী দুর্গার চরণের সিঁদুর নিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে তোলেন তারা।
শঙ্খ আর উলুধ্বনি, ঢাক-ঢোল-কাসরের বাদ্যের সঙ্গে চলে ভক্তদের নাচ। সাউন্ড সিস্টেমে দেবী বন্দনার গানে গানে আনন্দে মেতে ওঠেন ভক্তরা। প্রতিমা ঘাটে নেয়ার পর ভক্তকূল শেষবারের মতো ধূপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন। বিভিন্ন ঘাটে একে একে চলে প্রতিমা বিসর্জন। বিসর্জনকে কেন্দ্র কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে- প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয় কড়া ব্যবস্থা। প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে জল এনে (শান্তিজল) মঙ্গলঘটে নিয়ে তা আবার হৃদয়ে ধারণ করা হয়। আগামী বছর আবার এ শান্তিজল হৃদয় থেকে ঘটে, ঘট থেকে প্রতিমায় রেখে পূজা করা হবে। বিসর্জনের পর ভক্তরা শান্তিজল নেন এবং মিষ্টিমুখ করেন। সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় সপরিবারে দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে। ফিরবেনও ঘোড়ায় চড়ে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, দেবীর ঘোড়ায় আগমন ও গমন অশুভ ইঙ্গিত দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত করে। সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে এসবই অনুমান ভিত্তিক। দেবী নিজেই প্রকৃতির স্বরূপ। তাই দেবী কীভাবে ধরাধামে আসবেন, বা কীভাবে গমন করবেন, তা শুধু তিনি স্বয়ং জানেন। আসা- যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। সন্তানদের আশীষ দেবেন দুহাত ভরে। সারাদেশে এ বছর ৩২ হাজার ৪০৭টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্ন উদযাপনের জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখে। পাশাপাশি আয়োজকদের পক্ষ থেকেও মণ্ডপ পাহারায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয়। প্রতিটি মণ্ডপ ছিল সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। সব মিলিয়ে এবারে মায়ের পূজা শেষ হয়েছে নির্বিঘ্নেই। এটাও মায়ের আশিবার্দ।