প্রতিদিনের ডেস্ক॥ বিএনপি-জামায়াতের ডাকা টানা হরতাল-অবরোধে সংকটে দেশের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। ঢাকামুখী কিংবা ঢাকা থেকে দেশের অন্য স্থানে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে পণ্য সরবরাহ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নিরাপত্তার কথা ভেবে সব মালিক রাস্তায় ট্রাক ছাড়ছেন না। এ সুযোগে যারা পণ্য পরিবহন করছেন তারা ভাড়া বাড়িয়েছেন ২০-৩০ শতাংশ। একই দূরত্বে আগের তুলনায় বেশি গুনতে হচ্ছে দুই থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
পরিবহন মালিকদের দাবি, ঝুঁকির কারণে অনেকেই গাড়ি বের করতে চাচ্ছেন না। গাড়ি, চালক ও সহকারীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে বেশিরভাগ পরিবহন। তারপরেও ভাড়া উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে সংকটের কারণে বেশি নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুলিশি পাহারায় রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল করলেও সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি নিরাপত্তা নেই। ফলে কিছু কিছু পণ্যের পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাও ঘটেছে, যাতে পরিবহনের ক্ষতি হয়েছে।
আমরা যারা চুক্তিতে পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি নিচ্ছি তারাও সমস্যায় আছি। তাদের গাড়ির প্রফিট মার্জিন কমে গেছে। তারা এখন চাহিদামতো গাড়ি দিতে চাচ্ছে না। যেখানে যেখানে প্রফিট মার্জিন বেশি থাকছে সে গাড়িগুলো দিচ্ছে। কম গাড়ি থাকায় বেশিরভাগ মালিক মনোপলি ব্যবসা করছে। এখন ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
পরিবহন সংকট নিয়ে কথা হয় বেশকিছু পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। প্রায় সবাই পরিবহন সংকট এবং সে সুযোগ কাজে লগিয়ে একশ্রেণির পরিবহন মালিকের মনোপলি ব্যবসার কথা বলেছেন। আকিজ প্লাস্টিকস ও পিভিসি ডিস্টিবিউশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার আবু হেনা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা যারা চুক্তিতে পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি নিচ্ছি তারাও সমস্যায় আছি। তাদের গাড়ির প্রফিট মার্জিন কমে গেছে। তারা এখন চাহিদামতো গাড়ি দিতে চাচ্ছে না।’
আবু হেনা বলেন, ‘আবার অনেক ক্ষেত্রে দিতেও পারছে না। তাদের যেখানে যেখানে প্রফিট মার্জিন বেশি থাকছে সে গাড়িগুলো দিচ্ছে। এরপর বাইরে থেকে গাড়ি নিতে গেলে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে। কম গাড়ি থাকায় বেশিরভাগ মালিক মনোপলি ব্যবসা করছে। এখন ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।’
একটি গাড়ি যদি একদিন বসিয়ে রাখা হয় তাহলেও এর পেছনে পার্কিং খরচ, শ্রমিকদের বেতন দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। এভাবে প্রায় এক লাখের বেশি গাড়ি এ হরতাল-অবরোধে অচল বসে রয়েছে।
পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকদের দুই সংগঠন বলছে, হরতাল-অবরোধের কারণে পণ্য পরিবহন অর্ধেকে নেমেছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গাড়ি চলছে অর্ধেক। কিছু মালিক ঝুঁকির কারণে গাড়ি চালাচ্ছেন না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাড়া না হওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকার গাড়ি বসে রয়েছে। লোকসান গুনছেন তারা।
বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান-ট্রাকপণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মকবুল আহম্মেদ বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে দেশের পরিবহন ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। এর মধ্যে হরতাল-অবরোধের প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে মারাত্মকভাবে। বিশেষ করে পরিবহনে ক্ষতি ভিন্নমাত্রা নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মসূচির সব আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে ট্রাক-বাস।’
এ পরিবহন মালিক বলেন, ‘ঝুঁকির কারণে স্টাফরা (চালক ও সহকারী) ভাড়া নিয়ে যেতে চায় না। ভয় পাচ্ছে। যে পরিস্থিতি তাতে ব্যবসার লালবাতি জ্বলতে বাকি নেই।’
তবে মকবুল আহম্মেদ বলেন, ‘যে পরিমাণ ঝুঁকি তারপরেও ট্রাক আগের ভাড়ায় চলছে। কোথাও কোথাও দু-এক হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে, যেখানে একদম সংকট। তবে সার্বিকভাবে ভাড়া এখনো বাড়েনি।’
বরং তিনি বলেন, অনেক পরিবহন মালিক ভাড়া পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির কয়েকজন নেতা বলেন, একটি গাড়ি যদি একদিন বসিয়ে রাখা হয় তাহলেও এর পেছনে পার্কিং খরচ, শ্রমিকদের বেতন দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। এভাবে প্রায় এক লাখের বেশি গাড়ি এ হরতাল-অবরোধে অচল বসে রয়েছে।’
মালিকদের দুই সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট না হলেও সারাদেশে প্রায় তিন লাখ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান রয়েছে। রাস্তায় গাড়ি পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটছে। আব্দুল মজিদ নামে একজন গাড়ি মালিক জানান, একটি ট্রাক যদি আংশিক পোড়ানো হয় তাহলেও সেটা সারাতে লাখ পাঁচেক টাকা লাগে। আর যদি ইঞ্জিনসহ পুড়ে যায় তাহলে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ লোকসান মালিককে দিতে হয়। ইন্স্যুরেন্স থাকলেও সে সুবিধা পাওয়া যায় না।
পণ্য সরবরাহকারীরা জানান, আগে উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে ২০ থেকে ২১ হাজার টাকার মধ্যে চাল ও ডাল পরিবহন করা যেত। বর্তমানে সেই ভাড়া ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ট্রাকভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। অবরোধের আগে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত একটি আট টনের ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু এখন তা ২১ হাজার টাকা। সাড়ে ১২ টনের ট্রাকের ভাড়া ছিল ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকা, যা এখন ৩১ থেকে ৩২ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।
একইভাবে বেনাপোল থেকে পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক অবরোধের আগে ঢাকায় আসতো ১৫ হাজারের মধ্যে। এখন আসছে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকায়। তবে ঢাকা থেকে বেনাপোল যাওয়ার পথের ভাড়া কিছুটা কম, ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে।
তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে জহিরুল হোসেন নামে একজন কাভার্ডভ্যান মালিক বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। ট্রাকে আগুন দিলে তার দায় নেবে কে?’
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির দিনে পণ্যবাহী পরিবহন, তেলবাহী পরিবহন, দূরপাল্লার গণপরিবহন ও অন্য যানবাহন এস্কর্ট বা নিরাপত্তা দেবে র্যাব। গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় বিশেষায়িত সংস্থাটি।
গত ৩০ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত র্যাব দেশব্যাপী পণ্যবাহী পরিবহন, তেলবাহী পরিবহন, দূরপাল্লার গণপরিবহন ও অন্য যানবাহনের দুই শতাধিক কনভয়ের মাধ্যমে মোট ১৭ হাজারের অধিক যানবাহনকে নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে বলে জানানো হয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
