বার্তাকক্ষ ,, রাজধানীর মেরাদিয়ার বাসিন্দা শাহানা বেগম। আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। অপেক্ষা করছেন আউটডোরে। তবে রোগীর চাপ বেশি থাকায় শিশুকন্যাকে দীর্ঘসময় বসে তিনি। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।তার পাশে আউটডোরে বসেছিল ৯ বছরের শিশু রবিউল। সঙ্গে তার নানা শফিক মিয়া। রাজধানীর চট্টগ্রাম রোড এলাকা থেকে এসেছেন তারা। জানালেন দীর্ঘসময় চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে তারাও।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আউটডোরে ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়ে। আউটডোরজুড়ে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। তাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসক-নার্সরা রোগীদের ড্রেসিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চারদিকে শুধুই ছোটাছুটি।
আউটডোরে নাতিকে নিয়ে বসে থাকা শফিক মিয়া জানালেন নাতির পা আগুনে পোড়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা না নিয়ে চুন লাগানোর কারণে আজকে তার এ ভোগান্তি। তিনি বলেন, ‘আমার নাতি রবিউল বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে গিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে মাঠের এক কোণে শিশুরা আগুন জ্বালিয়ে পোহাচ্ছিল। সেখানে অন্যমনস্ক হয়ে আগুনে পা চলে যায় ওর। এতে পা কিছুটা পুড়ে যায়। পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার পরামর্শে ওর পায়ে চুন লাগানো হয়। এতে ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়েছে। পরে স্থানীয় চিকিৎসকরা বার্ন ইনস্টিটিউটে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এজন্য এখানে নিয়ে এসেছি।’
স্বাভাবিকভাবেই শীতে আগুনে পোড়া রোগী বেড়ে যায়। বার্ন রোগীদের জন্য আমাদের নির্ধারিত শয্যা রয়েছে। এরপরেও শয্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তির চেষ্টা করে থাকি। সারাদেশ থেকেই এখানে রোগী আসেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তা অসম্ভব নয়।
আর আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে আসা শাহানা বেগম বলেন, ‘মেয়েকে গোসল করানোর জন্য পানি গরম করে বালতিতে রাখছিলাম। কাজ করতে রান্নাঘরে গেলে ওই বালতিতে মেয়েটা পড়ে যায়। এতে ওর মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আউটডোরের টিকিট দেওয়া হয়। এ চার ঘণ্টায় প্রতিদিন ২৮০-৩০০ রোগী আসেন। তবে ১৯ জানুয়ারি দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত রোগী এসেছেন ৩০২ জন।
দেশে শতকরা ৬০-৮০ শতাংশ বার্ন হচ্ছে গ্যাসের চুলার লিকেজ থেকে। আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। সেটা আর নেভানো হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকলে বার্নের ঘটনা ৬০ শতাংশ কমে যাবে। ইদানিং ইলেকট্রনিক বার্নও অনেক বেশি হচ্ছে। এটি প্রতিরোধে বাড়ির জানালা চার ফিটের মধ্যে কোনো ইলেকট্রিক তার রাখা যাবে না। বাড়ির ছাদ, গাছের ডালের মধ্য দিয়েও কোনো তার আছে কি না, খেয়াল করতে হবে। থাকলে সরিয়ে দিতে হবে। এগুলো মেনে চললে আরও ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে
দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানান, আউটডোরে সবসময়ই রোগীদের ভিড় থাকে। তবে শীতকালে তুলনামূলক দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। প্রতিদিন আউটডোর থেকে ছয় থেকে সাতজন রোগী আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকেন। আসন ফাঁকা থাকলে আরও বেশি রোগীকেও ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেখ হাসিনা বার্নে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৫ হাজার ৮১৬ রোগী। এর মধ্যে অক্টোবর মাস থেকে প্রতি মাসে রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। এছাড়া ২০২২ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন চার হাজার ৯১৮ জন। এর মধ্যে অক্টোবর থেকে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪৫০-এর নিচে নামেনি।
শীতকালে আগুনে পোড়া রোগী বেড়েছে কি না, জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই শীতের সময় আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বার্ন রোগীদের জন্য আমাদের নির্ধারিত শয্যা রয়েছে। এরপরেও শয্যা বাড়ানো হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তির চেষ্টা করে থাকি। সারাদেশ থেকেই এখানে রোগী আসেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তা অসম্ভব নয়।
কারা বেশি চিকিৎসা নিতে আসছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শীতে দগ্ধ রোগীদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। নারী ও শিশুদের জন্য বেড বাড়িয়ে হলেও আমরা চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেমন পুরুষ হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) আমরা শুধু পুরুষ রোগী রাখতাম, যেখানে আলাদা ব্লক তৈরি করে ১০ জন নারী রোগী রাখার ব্যবস্থা করেছি। নারী ও বাচ্চাদের এইচডিইউতে ৩০ বেড ছিল না, এখন ৪০ বেড করেছি।’
ডা. আবুল কালাম বলেন, ২০১১ সাল থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ১৫০ জন প্লাস্টিক সার্জন তৈরি করতে পেরেছি। আমাদের প্রয়োজন ২০০-৩০০ জন। চাইলেই জনবল তৈরি করা যায় না। দক্ষ জনবল তৈরিতে সময় প্রয়োজন। ফলে অপারেশনে কিছুটা সময় লাগছে। তবে এটা খুব বেশি সমস্যা তৈরি করছে না
তিনি আরও বলেন, রোগীদের ৮০ শতাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। তবে তাদের বেশিরভাগই পর্যাপ্ত প্রাথমিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এটি না হওয়ার কারণ দুটি। একটি হচ্ছে, চিকিৎসকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা রয়েছে। রোগীদের পোড়া অংশে ঐতিহ্যগতভাবে চুন, টুথপেস্ট, ডিম লাগানো হয়। এগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন- কাঁচা ডিমে প্রোটিন থাকে। প্রোটিন যেখানে থাকবে, সেখানে ইনফেকশন হবেই। টুথপেস্টে ক্যামিকেলস থাকে, চুনের উপাদান বার্নটিকে আরও ডিপ করে। যেটা হয়তো ১০ দিনে ঠিক হয়ে যেতো, সেটা ঠিক হতে দীর্ঘসময় লাগে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হিসেবে পানি ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করা যাবে না। পোড়া স্থানে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। টানা ৪০ মিনিট ঠান্ডা পানি ঢাললেও রোগী অনেক উপকার পাবেন।
বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, এখন তৃণমূল পর্যায়ে বার্নের চিকিৎসা পৌঁছানোর বিষয়টি একদিনের বিষয় নয়। এটি প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত চেষ্টার প্রয়োজন। এখন প্রায় প্রত্যেক জেলায় মেডিকেল কলেজ হয়েছে। এসব হাসপাতালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালু করতে হবে। অনেক হাসপাতালে চালুও হয়েছে। সব মেডিকেল কলেজগুলোতে যদি চিকিৎসকদের তিনদিনের একটা ওরিয়েন্টেশন ক্লাস করানো যায়, তাহলে তারা জেলা-উপজেলায় প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু দিতে পারবেন। রোগীর চাপও কমে আসবে।
সর্তক থাকার বিকল্প নেই জানিয়ে ডা. আবুল কালাম আরও বলেন, বার্ন কোনো ইনফেকশন বা টিউমার না। সোর্স দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে, তাহলে কোটি কোটি টাকার রিসোর্স ব্যয়ের প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের এ ধরনের অবস্থায় সবার প্রতি একটাই পরামর্শ, অবশ্যই সর্তক থাকবেন।
তিনি বলেন, ‘শতকরা ৬০-৮০ শতাংশ বার্ন হচ্ছে গ্যাসের চুলার লিকেজ থেকে। আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সেটা আর নেভানো হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকলে বার্নের ঘটনা ৬০ শতাংশ কমে যাবে। ইদানিং ইলেকট্রনিক বার্ন অনেক বেশি হচ্ছে। এটি প্রতিরোধে বাড়ির জানালা চার ফিটের মধ্যে কোনো ইলেকট্রিক তার রাখা যাবে না। বাড়ির ছাদ, গাছের ডালের মধ্য দিয়েও কোনো তার আছে কি না, খেয়াল করতে হবে। থাকলে সরিয়ে দিতে হবে। এগুলো মেনে চললে আরও ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে। এতে তো ৮০ শতাংশ ঘটনা রোধ হয়ে যায়। বাকি ২০ শতাংশ সারা বিশ্বেই ঘটে। আর এটুকু সহজেই চিকিৎসা দেওয়া যাবে। সেই সক্ষমতা আমাদের আছে
