অদ্বিতীয় শেখ হাসিনা

0
30

মোনায়েম সরকার
রাজনৈতিক কৌশল ও বুদ্ধিমত্তায় তাঁর সমকক্ষ যে দেশে আর কেউ নেই সেটা আবার প্রমাণ করলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বহুমাত্রিক স্মার্ট নেতৃত্বগুণ আবার প্রত্যক্ষ করলো বিশ্ব ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে। জাদুকরী নেতৃত্বের কারণে টানা চতুর্থবারসহ মোট পঞ্চমবারের মতো নিজ দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নেওয়ার সাফল্য দেখালেন তিনি। নিজেও টানা চতুর্থবার ও মোট পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এত দীর্ঘ সময় গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় থাকার আর কোনো নজির নেই।
শুধু রাষ্ট্রনায়কই নন; বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বের তালিকায়ও রয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার নাম। ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০২৩ সালের বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ৪৬তম অবস্থানে রয়েছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেন পলিসি নামক সাময়িকীর করা বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০ বৈশ্বিক চিন্তাবিদের তালিকাতেও নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২২৫ আসনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২ আসনে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা (যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা), ১১ আসনে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করেছে। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পেয়েছে।
লৌহমানবী হিসেবে পরিচিত জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল টানা চার মেয়াদে ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন ১৫ বছরের কিছু বেশি সময়। তাদের রেকর্ড আগেই ভেঙেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন তৈরি করছেন নতুন ইতিহাস।
বাংলাদেশে অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনন্য বৈশিষ্ট রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি দল এই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। ট্রেন, বাস ও ভোটকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিয়ে ভোটারদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে তারা। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র ও নাশকতা উপেক্ষা করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত করে ৪১.৮ শতাংশ ভোটার তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করেন। যা একটি সফল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বিএনপির মতো একটি বড় দলের বর্জন, নাশকতা ও প্রতিরোধের মুখে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার শঙ্কা কাটাতে এক বিচক্ষণ কৌশল নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার লক্ষ্যে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী মনোনয়নের পাশাপাশি নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেন তিনি।
এতে জমজমাট একটি ভোটের আবহ সৃষ্টির পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহও তৈরি হয়- যার ফল মেলে বিপুল ভোটার উপস্থিতিতে। অবশ্য এর ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়েও হেরে যান দল ও জোটের অনেক প্রার্থী। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট রাজনীতিকও রয়েছেন। গোপালগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি সফল নির্বাচন উপহার দেয়ার পেছনে শেখ হাসিনার অন্যতম কৌশল ছিল দলীয় প্রার্থীর বাইরে নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত করা। গত ২৬ নভেম্বর বিকালে ৩০০ আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এর আগে গণভবনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। সেখানে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে মনোনয়নবঞ্চিত দলের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দেন তিনি। তার এই ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক বড় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট শরিকদের হারতেও হয়েছে। এমনকি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া কয়েকটি আসনেও লাঙ্গলকে হারতে হয়েছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে।
নৌকার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, ১৪ দলীয় জোট শরিক ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও নির্বাচনটি মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে। ফলে তৃণমূলে তৈরি হয়েছিল ভোটের আমেজ। ভোটাররাও বেশ উচ্ছ্বসিত মনোভাব নিয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে তাদের ভোট প্রয়োগ করেছেন।
শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে বাংলাদেশকে আমূল পরিবর্তন করতে পেরেছেন। বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করেছেন তিনি। দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব উড়িয়ে দিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জয়ের মাধ্যমে শুরু হয় মহাউন্নয়নযজ্ঞ। এরপর টানা ক্ষমতায় থেকে দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করে তার সরকার- যার কৃতিত্ব অনেকটা এককভাবে শেখ হাসিনার। ১৫ বছরে বাংলাদেশকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
একটি নতুন স্মার্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নেবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, আর্থিক খাতের অনিয়ম দূর করে এবং পুঁজিপাচার রোধে দৃঢ়তা দেখাতে পারলে নিন্দুকদের মুখও বন্ধ হবে।
দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ ও পাকাকরণ, শিক্ষা, চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন তিনি। এছাড়া দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা, পোশাক খাতে উন্নয়ন, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর হস্তে কাজ করেন শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ দমন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কারণে এসব নেতিবাচক প্রভাব গত দেড় দশকেও সেভাবে প্রবল হতে পারেনি।
মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানো, নারীর ক্ষমতায়ন, সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন, গ্রামীণ পরিবেশেও শহুরে সেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নিজের তত্ত্বাবধানে দেখভাল করেন নিজেই। শেখ হাসিনা প্রশ্নে আপসহীন নেতাকর্মীদের অবস্থান।
টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন। মেগাসিটি ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি টানেল, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তার হাতেই করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কাজও প্রক্রিয়াধীন। দেশি-বিদেশি সব অপবাদ উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ একমাত্র শেখ হাসিনাকে দিয়েই সম্ভব হয়েছে। জঙ্গিবাদ দূর করতেও সফল তিনি।
ভোটের সার্বিক পরিস্থিতিতে বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের পর্যবেক্ষক দল প্রশংসাসূচক ও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সাত-আটটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে এত ভোটারের উপস্থিতি ও ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা খুবই সন্তুষ্ট এবং ভীষণ আশাবাদী। রাজধানীর বাইরে চল্লিশ থেকে সত্তর শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন তারা। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরবেন বলেও জানান যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের পর্যবেক্ষক দল।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ফিলিস্তিনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাশিম কুহাইল বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। ভোট শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটের পরিবেশও খুব ভালো ছিল। নাগরিকদের ভোট দেয়ার প্রক্রিয়াও খুব সহজ ছিল। এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যেই ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিবিদ জিম ব্যাটস বলেন, ভোট সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে ভোট পরিচালনা করেছে। কানাডার এমপি চন্দ্রকান্থ আরিয়া বলেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। ভোটে রেকর্ডসংখ্যক নারী ভোটার উপস্থিত ছিলেন। আমরা ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনো কেন্দ্রে ভিজিটের সুযোগ পেয়েছি। সবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা ভোট বয়কট করেছে, সেটা তাদের বিষয়, এটা আমাদের বিষয় না। কানাডায়ও ভোট ৪৩ শতাংশ পড়েছিল, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। জনগণ ভোট দিতে পারছে কি না, এটাই দেখার বিষয়। নাইজেরিয়ার সিনেটর প্যাট্রিক সি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। স্থানীয়দের উৎসাহের সঙ্গে ভোট দিতে দেখেছি। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে।
সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে প্রধান বিরোধী দল এলে নির্বাচন আরো অংশগ্রহণমূলক হতো। স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও ভোট পদ্ধতির প্রশংসা করেনি তিনি। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে শুটব বলেন, নির্বাচন স্বচ্ছ, খোলামেলা ও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। ভোটের নিরাপত্তার পরিবেশও খুব ভালো ছিল। ভোটের প্রশংসা করে আরো প্রতিক্রিয়া জানান, স্কটিশ পার্লামেন্ট, ওআইসি, আরব পার্লামেন্ট ও গাম্বিয়ার প্রতিনিধিরা।
মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি স্বভাবসুলভভাবে নির্বাচন সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আন্দোলনে অসফল বিএনপিকে কার্যত নিঃস্ব করে পথে বসিয়ে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় তিনি অদ্বিতীয়। একটি নতুন স্মার্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নেবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, আর্থিক খাতের অনিয়ম দূর করে এবং পুঁজিপাচার রোধে দৃঢ়তা দেখাতে পারলে নিন্দুকদের মুখও বন্ধ হবে।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।