প্রতিদিনের ডেস্ক
স্কুলজীবনেই শুরু করেন ফেসবুক ব্যবহার। প্রযুক্তি-জ্ঞান তখনও শূন্যে। ফেসবুকে আইডি খুলে একের পর এক সমস্যার মুখে পড়েন স্কুলছাত্র মাহমুদুল হাসান আলপন। আশপাশের কাউকে সমস্যা বললেও সমাধান দিতে পারতেন না। বাধ্য হয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে নামেন নিজেই। একটা সময় এ কাজ শখে পরিণত হয় তার। এসএসসি-এইচএসসির গণ্ডি পেরিয়ে মাহমুদুল এখন স্নাতক পড়ুয়া। কিন্তু এখন তার বড় পরিচয় ‘সোশ্যাল মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ার’।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীবর্ষের ছাত্র মাহমুদুল তার বন্ধুর সঙ্গে গড়ে তুলেছেন ‘আইটি স্টোর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তার বন্ধু তোহা ইব্রাহিম সিজান অবশ্য কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। পড়ছেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ডিআইইউ)। দুজনে মিলে কাজ করছেন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুরক্ষার। এরই মধ্যে তারা শতাধিক হ্যাকড, ডিজঅ্যাবলসহ নানা সমস্যায় পড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ, আইডি সফলভাবে উদ্ধার করে ব্যবহারকারীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সলিমউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান আলপন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও কোনো পেজ-আইডি হ্যাকড হলে তা উদ্ধারের কাজ করি আমরা। অনেকের আবার নানান কারণে অ্যাকাউন্ট ডিজঅ্যাবল হয়ে যায়। সেটাও রিকভারের কাজ করি। কেউ ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে তাকেও গাইড করি।’
কতটা সফলভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ করছেন মাহমুদুল ও তোহা? এমন প্রশ্নে তোহা ইব্রাহিম সিজান বলেন, ‘২০১৭ সালের দিক থেকে কাজ শুরু করেছি। সফলভাবে অনেক কাজই করেছি। সেভাবে হিসাব রাখা হয়নি। আনুমানিক একশ’র বেশি বিভিন্ন পেজ হ্যাকড, ডিজঅ্যাবলসহ অন্যান্য জটিলতা থেকে ব্যবহারকারীকে রিকভার করে দিয়েছি।’
শুধু হ্যাকড নয়, অনেকের পেজ ডিজঅ্যাবল হয়ে যায়। অনেক ফলোয়ার্স পেজে। মনিটাইজেশন ছিল, হঠাৎ মনিটাইজেশন চলে গেছে। সেগুলো নিয়েও কাজ করি আমরা। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের আইটি সাপোর্ট দিয়ে থাকি। যেমন— ওয়েবসাইট, অ্যাপ ডেভেলপমেন্টও।
অন্যদিক, আইটি সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছুটে চলা এ তরুণ ‘সোশ্যাল মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ার’ হয়ে ওঠার গল্প জানিয়েছেন। মাহমুদুল বলেন, ‘২০১২-২০১৩ সালের দিকে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে। তখন নতুন অনেকে ফেসবুক আইডি চালু করে নানা সমস্যায় পড়তেন। আইডি ডিজঅ্যাবল হয়ে যেতো, সহজেই হ্যাকড হতো। আমি নিজেও ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম তখন। বয়সে বেশ ছোট। দেখতাম— আজ এ সমস্যা, তো কাল আরেক সমস্যা। ফেসবুকে অনেক বাগ ইস্যু থাকতো। অনেক ইউজারের অ্যাকাউন্ট কারণ ছাড়াই ডিজঅ্যাবল হয়ে যেতো। লকে পড়ে যেতো।’
তিনি বলেন, ‘দেখুন, একটা ফেসবুক আইডিতে অনেক বন্ধু যুক্ত হয়। ওই আইডিটা হারালে বন্ধুদের হারাতে হতো। সমস্যা সমাধান করার মতো কোনো পথ পেতাম না। মোবাইলের সিমে সমস্যা হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমার কেয়ারে কল দিই, সমস্যাটা জানিয়ে ঠিক করে নিতে পারি। কিন্তু ফেসবুকে সমস্যা হলে এমন কোনো সুবিধা নেই। সহজে কেউ এটা ঠিক করার উপায়ও বাতলে দিতে পারতো না। সেই সুযোগও ছিল না। তখন থেকেই নিজে ঘাটাঘাটি শুরু করি। নিজে কিছু স্টাডি করতে থাকি। সমস্যা সমাধানে সোশ্যাল মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথে হাঁটা তখন থেকেই শুরু। বলা চলে কিশোর বয়সে এটা একটা সময় শখে পরিণত হয়। এরপর এখন এটাকেই প্রফেশন (পেশা) হিসেবে বেছে নেওয়া।’
তোহা ইব্রাহিম সিজানের গল্পটাও একই রকম। যখন তিনি আইটি নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন এইচএসসির ছাত্র। পরে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হয়েছেন। তোহা বলেন, ‘আমরা কাজটা বেশিরভাগই করি অফলাইনে। অনলাইনে সেভাবে আমরা ফেসবুক পেজে খুব সক্রিয় ছিলাম না। সম্প্রতি আইটি স্টোর নামে ফেসবুক পেজটা চালু করেছি। এখন অনলাইন-অফলাইন দুই জায়গায়ই আমাদের পাওয়া যাচ্ছে। যে কেউ পেজের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারেন।’
মাহমুদুল হাসান আলপন বলেন, ‘অনেক সরকারি সংস্থার সঙ্গে আমরা কানেক্টেড। তাদের কাছে কেউ সহায়তা চাইলে সেই সংস্থা আমাদের ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতো। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনালের (সিটিটিসি) সঙ্গেও আমরা কানেক্টেড। তারা আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে কাজে লাগান। সিটিটিসিতে আছি তিন বছর ধরে। এখান থেকে পেজ রিকভারিসহ বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়।’
কতটা সফল তোহা-মাহমুদুল?
কারও ফেসবুক পেজ বা আইডি হ্যাকড কিংবা ডিজঅ্যাবল হলে তা উদ্ধারে কাজ করেন তোহা ও মাহমুদুল। তবে, তা সফলভাবে করতে পেজের ওনার বা মালিকের সহযোগিতা প্রয়োজন।
মাহমুদুল বলেন, ‘এটা নির্ভর করে যার পেজ হ্যাকড হয়েছে, তিনি কতটা তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন। কীভাবে হ্যাক হয়েছে, কবে থেকে পেজের নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছেন না, কোন ফিশিং লিংকে ক্লিক করেছিলেন— এসব ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। সফলভাবে তখন দ্রুত পেজটা রিকভার করা সম্ভব হয়। তখন পেজ-আইডি যাই বলেন, শতভাগ নিশ্চিতভাবে সেটা উদ্ধার করা যায়।’
সাইবার জগৎ সুরক্ষাই প্রধান লক্ষ্য জানিয়ে তোহা ইব্রাহিম বলেন, ‘সাইবার ইস্যু অনেক ব্যবহারকারী বোঝেন না। অনেকে বুঝে কিংবা না বুঝে ফেসবুকে বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে কিংবা অনলাইনে ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকের এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে ক্যারিয়ার। আবার অসংখ্য বিজনেস পেজ এখন গড়ে উঠছে। কিন্তু বিষয়গুলো ভালোভাবে না জানায় বলা চলে বড় বড় এসব পেজ তারা এক রকম হ্যাকারদের হাতে তুলে দেন। এসব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করাটাও আমাদের লক্ষ্য।’
তোহা ও মাহমুদুলের ভাষ্য, দেশের মানুষ সাইবার ইস্যুতে সচেতন হোক। সাইবার প্ল্যাটফর্মে সবাই নিরাপদে থাককু এটাই চাওয়া। তার মধ্যেও যদি কেউ সমস্যায় পড়েন, তাহলে দ্রুত তিনি কীভাবে সেবাটা পেতে পারেন, তা জানাতে চাই আমরা। একবার হ্যাক হওয়ার পর তারা যেন নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারেন। যাতে দ্বিতীয়বার আর ঝুঁকিতে না পড়েন। সাইবার প্ল্যাটফর্মে মানুষ যেন সুরক্ষিত থাকে সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করবো।
তারা আরও জানান, ফেসবুক বা অনলাইনকেন্দ্রিক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হলেও অনেকে জানেন না তারা কোথায় গেলে সমাধান পাবেন। কাদের সাহায্য, কীভাবে নিতে পারে সেটাও বোঝেন না। প্রক্রিয়াটা কেমন হবে— সেগুলো আমরা জানিয়ে থাকি। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য কীভাবে পাবেন, মামলা করবেন কীভাবে— সেগুলোও আমরা গাইড দিয়ে থাকি।’