নিরঞ্জন রায়
অনেক শঙ্কা, অনিশ্চয়তা এবং প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সফলভাবেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশ্বের সব দেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকে এবং আমাদের দেশের সব নির্বাচন নিয়েই একটু বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে। তাই বর্তমান নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই। মূল কথা এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ ছিলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১. সন্তোষজনক ভোটার উপস্থিতি, ২. নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা সহিংসতামুক্ত রাখা, ৩. নির্বাচনে কোনোরকম কারচুপি না হওয়া এবং ৪. মোটামুটি অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। এসব চ্যালেঞ্জ যথেষ্ট সফলভাবে মোকাবেলা করেই এবারের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটাই এখন বাস্তবতা। শিগগিরই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য শপথ নিবেন এবং নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, যাঁদের প্রধান দায়িত্ব হবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সরকার পরিচালনা এবং আওয়ামী লীগের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা।
বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে, তাতে তাঁদের অনেক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আর বিরাজমান এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং অস্থিরতা সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের থাকতে হবে ভাল একটি মন্ত্রিসভা, যেখানে দায়িত্বে থাকবেন দক্ষ-অভিজ্ঞ এবং সঠিকভাবে ডেলিভার করতে পারবেন এমন ব্যক্তি। বিশেষ করে অর্থ, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য এবং তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন সবচেয়ে যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ ভালো বোঝেন এমন ব্যক্তিদের ওপর। কেননা
আগামীতে নতুন সরকারকে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ, অনিশ্চয়তা এবং প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়, তার অধিকাংশই এই কয়টি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত। ফলে এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যেসব মন্ত্রী থাকবেন তাঁরা যদি পরিস্থিতি আগে থেকে আঁচ করে স্ব-উদ্যোগী পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, তাহলে অনেক সমস্যাই আগে থেকে সমাধান করা সম্ভব হবে। যেমন আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ তাদের নীতিসুদের হার বা বেঞ্চমার্ক রেট আর বৃদ্ধি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে এবং এই বছর থেকে এই সুদের হার হ্রাস করার কথা থাকলেও কবে থেকে সেটি হতে পারে সে ব্যাপারে তারা ধারণা দিতে পারেনি।
তবে অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে এবছরের শেষের দিক থেকে ফেডারেল রিজার্ভ তাঁদের রেট-কাট শুরু হতে পারে। এই ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে আগামী বছর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী নেমে যাওয়ার কথা। সেই অবস্থার সুযোগ নিতে, বিশেষ করে আমেরিকায় সুদের হার কমতে থাকলে আমাদের দেশে অধিক ডলার আনার যে সুযোগ সৃষ্টি হবে তাকে কাজে লাগানোর প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। এসব বিষয় ভালোভাবে বুঝে স্ব-উদ্যোগে বা প্রো-অ্যাকটিভ সিদ্ধান্ত নিতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। এরকম অনেক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত যে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে তেমন নয়, বাণিজ্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়কেই এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে পারদর্শী একজন ব্যক্তিকে। আগামী দিনে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা থেকে বিভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জ আসা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কূটনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি আরো অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আমাদের দেশের একটি মহল সবসময় অপপ্রচারে লিপ্ত থাকে এবং এখানকার সরকার ও নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার এবং দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে থাকে।
আগামীতেও যে এই দেশবিরোধী মহলের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকা-কানাডায় বসবাসরত দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি নাগরিক নিজ উদ্যোগে এসব দেশবিরোধী মহলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, কিন্তু অধিকাংশ পদক্ষেপ অনেক দেরিতে নেয়া হয়। ফলে খুব একটা সফলতা পাওয়া যায় না। এসব ব্যাপারে স্ব-উদ্যোগে এবং অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কূটনীতি এবং কূটনীতি বহির্ভূত বিষয়গুলো বেশ ভালো বোঝেন এবং এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারদর্শী এমন মন্ত্রীকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। দক্ষ এবং উপযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যায় তার বড় উদাহরণ ভারত। তাই আমাদেরও এখন সেভাবেই চিন্তা করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিও। গত সরকারের অনেক আকাশচুম্বী সফলতা থাকা সত্ত্বেও মানুষের সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ ছিলো দ্রব্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। নিশ্চয়ই অনেক যুক্তিসংগত কারণ ছিলো। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বিশ্ব বাজারে যেভাবে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি এবং লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে আমাদের দেশে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য কমে এখন বেশ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। অথচ এর প্রভাব আমাদের দেশের বাজারে সেভাবে পড়েনি। তাই দেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর এবং বাস্তবায়নে পারদর্শী এরকম ব্যক্তিকেই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত নয় কিন্তু ব্যবসার গতিপ্রকৃতি ভালো বোঝেন এরকম একজনকে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি পোর্টফলিও। এই মন্ত্রণালয়ের সামনেই আছে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যা। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে আগামী দিনে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা থাকলেও, মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে অনেক আর্থিক নীতি গ্রহণ এবং কিছু বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন আছে। দেশে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে করদাতার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে আয়কর রিটার্নের আওতায় আনতে আয়কর ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল এবং আধুনিক করতে হবে। জনবান্ধব রিটার্ন দাখিল পদ্ধতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে হবে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি মানসম্পন্ন অবস্থায় নিতেই হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। বরং যত দ্রুত এই কাজটি করা যায়, ততই ভাল। ডলার সংকট কাটিয়ে উঠে রিজার্ভ পূর্বের অবস্থায়, অর্থাৎ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে অতি সত্বর। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত ডলার সংগ্রহ করে ডলারের বা বৈদেশিক মুদ্রার নিজস্ব একটি বাফার স্টক গড়ে তুলতে হবে। ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ডলারের এই সাপোর্ট থাকতে হবে।
দেশের খেলাপি ঋণের একটি সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। দেশের পুঁজিবাজার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে বিগত কয়েক বছর ধরে, যা মোটেই ভাল লক্ষণ নয় এবং এই অবস্থা আর এক মুহূর্তও চলতে দেওয়া যায় না। তাই দেশের পুঁজিবাজার কার্যকর এবং আকর্ষণীয় বিনিয়োগবান্ধব করে তোলার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে হবে। তাই এই মন্ত্রণালয়ের খুব দ্রুত এবং কার্যকর অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এসব বিষয়ে যাদের পাণ্ডিত্য এবং অভিজ্ঞতা আছে এমন কাউকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
তাছাড়া সম্পত্তি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কলেবর এবং পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় বাজেটের আকার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেট প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন এখন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। তাছাড়া সরকারের চলমান অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সংগ্রহ এবং ছাড়ের দায়িত্বও পালন করতে হয় এই মন্ত্রণালয়কে। এসব দায়িত্ব পালন করে দেশের পুঁজি বাজার এবং ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ সেভাবে থাকে না। তাই সম্ভব হলে এই মন্ত্রণালয়ে একজন পূর্ণ বা ফুল মন্ত্রীর পাশাপাশি একজন প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী কে শুধুমাত্র পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের জন্য দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের দেশের মন্ত্রিপরিষদে বেশ কয়েকজন উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী থাকেন। তাই তাদের একজনকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে শুধুমাত্র পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের জন্য দায়িত্ব দেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
ভালো এবং শক্তিশালী মন্ত্রিপরিষদ হলে সরকারের নীতি এবং নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের কাজ অনেক সহজ হয়। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ কম পড়বে। অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি যেসব সিদ্ধান্ত মন্ত্রীদের নেওয়ার কথা সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হয়েছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর অত্যাধিক চাপ পড়ে এবং তাঁকে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে সবকিছু নখদর্পণে রাখেন এবং সবকিছুতে সিদ্ধান্ত দেন তাতে অবাক হতে হয়।
তাই মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত দায়িত্বগুলো যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে থেকেই সম্পন্ন করা যায় এবং এসব বিষয় যদি প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে না হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারবেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে আগামী দিনের চলার পথ মোটেই মসৃণ হবে না, বরং যথেষ্ট কণ্টকাকীর্ণ হবে। থাকবে অনেক চ্যালেঞ্জ, সমস্যা এবং প্রতিবন্ধকতা। এসব সফলভাবে মোকাবেলা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের একটি ভালো এবং উপযুক্ত মন্ত্রিসভা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিবেচনায় বিষয়গুলো আছে এবং তিনি আমাদের সেরকম একটি মন্ত্রিসভা উপহার দেবেন।
লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা।