প্রতিদিনের ডেস্ক
সাইদুল ইসলাম দু’বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। তার নিয়মিত ডায়ালাইসিস চলছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য পাচ্ছেন না ডোনার। তিনি বলেন, আত্মীয়-স্বজন অনেকের কাছেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সেভাবে কেউ সাড়া দেয়নি। আমরা গরিব মানুষ এতো টাকাও নাই যে কোনোভাবে ম্যানেজ করে খরচ করবো, দেশের বাইরে যাবো। এখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করেই জীবন পার করতে হচ্ছে।
সাইদুলের মতো দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা এখন ক্রমাগত বাড়ছে। জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, ধূমপান, যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক সেবনের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল। সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বাংলাদেশ (এসওটি), বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ১০টি প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে খরচ কম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে। অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারি এই হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে। এখন এক লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে এই চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়।
হাসপাতালের সূত্রে জানা যায়, বিএসএমএমইউ ও এর অধীনে থাকা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল দুই জায়গাই হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। তবে আগে সপ্তাহে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো। বর্তমানে সপ্তাহে দুই প্রতিষ্ঠান মিলে হয় দুইটি। তবে এ বছরের মার্চের মধ্যে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে।
মার্চ থেকে ৩ থেকে ৪টা কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। সেই পরিমাণ জনবল ও সাপোর্ট আমাদের আছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আলাদা করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট স্যুইট, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ আছে এবং তা উন্নত বিশ্বের মতো অবস্থায়ই আছে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট একটি দলগত কাজ। এখানে নেফ্রোলোজিস্ট এর বড় রোল আছে। প্রি অপারেটিভ ও পোস্ট অপারেটিভ অনেক কাজ করে তারা। আর ট্রান্সপ্ল্যান্টের যে মূল সার্জারি হয় সেখানেও তিনটি আলাদা দল কাজ করে। পুরো দল মিলে ৭ থেকে ১০ জনের মতো কাজ করে এই সার্জারির সময়। একটি টিম কিডনি দাতা থেকে কিডনি গ্রহণ করে, আরেকটি টিম কিডনিটা নিয়ে সেটিকে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করে। আর আরেক টিম এই কিডনি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করে।
দেশে বিএসএমএমইউ সর্বপ্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করলেও এখনও সংখ্যা কম কেনো জানতে চাইলে বিএসএমএমইউয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, বিএসএমএমইউ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশে যারা কিডনি প্রতিস্থাপন করছে তাদের বেশিরভাগই এখান থেকে পড়াশোনা করে গেছেন, এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছেন। এ পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে ৬১০টি। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। অনেক হাসপাতাল নতুন করে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চায়। যেমন শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট নতুন করে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করতে চায়। তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের সব লজিস্টিক সাপোর্ট এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
তিনি জানান, মার্চ থেকে তিন থেকে চারটা কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। সেই পরিমাণ জনবল ও সাপোর্ট আমাদের আছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আলাদা করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট স্যুইট, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ আছে এবং তা উন্নত বিশ্বের মতো অবস্থায়ই আছে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট একটি দলগত কাজ। এখানে নেফ্রোলোজিস্টের বড় রোল আছে। প্রি-অপারেটিভ ও পোস্ট অপারেটিভ অনেক কাজ করে তারা। আর ট্রান্সপ্ল্যান্টের যে মূল সার্জারি হয় সেখানেও তিনটি আলাদা দল কাজ করে। পুরো দল মিলে সাত থেকে ১০ জনের মতো কাজ করে এই সার্জারির সময়। একটি টিম কিডনিদাতা থেকে কিডনি গ্রহণ করে, আরেকটি টিম কিডনিটা নিয়ে সেটিকে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করে। আর আরেক টিম এই কিডনি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করে।
হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, আরেকটা সংশোধন হয়েছে ২০১৯ সালের এক রিটে উচ্চ আদালত ইমোশনাল ডোনার হিসেবে কিডনি দেওয়ার জন্য অর্ডার দিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। তবে মন্ত্রণালয় এখনো এই রায় আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেনি। এই আইন হলে সবাই সবাইকে দিতে পারতো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন কম হওয়ার অন্তরায় হিসেবে একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। ডাক্তার, সাংবাদিক হতে শুরু করে অনেক ভালো চেহারার মানুষও এর সঙ্গে জড়িত। তারা চায় না দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন, ক্যাডাবেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফল হোক। তাদের কারণে রোগীরা বিদেশে অনেক বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে কিডনি প্রতিস্থাপন করছে। আমরা একটা ভালো কাজ শুরু করলে নানা ধরনের সমস্যা সামনে নিয়ে আসে। আমাদের কার্যক্রম চলছে। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরও বেশি গতি পাওয়ার আশা তার।
‘ডায়ালাইসিস করালে কিডনির শুধু বেসিক কিছু ফাংশন কাজ করে। সব ফাংশন করাতে ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিকল্প নেই। ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য বড় অন্তরায় হলো, আমাদের দেশে এ বিষয়ে অতো প্রচারণা নেই। দ্বিতীয়ত ডোনার নেই। এছাড়া, আমাদের অর্থ নেই এবং সাপোর্ট নেই। দেশে নেতিবাচক প্রচারগুলো বেশি হয়। পজিটিভ অ্যাটিচ্যুড কোনো লেভেলে নেই, যার কারণে যে কোনো একটা প্রবলেমে এটা (ট্রান্সপ্ল্যান্ট) থেমে যেতে পারে। এটা সাকসেসফুল করতে সবার হেল্প লাগবে
বিএসএমএমইউয়ের ইউরোলজির চিকিৎসকরা বলেন, ‘ডায়ালাইসিস করালে কিডনির শুধু বেসিক কিছু ফাংশন কাজ করে। সব ফাংশন করাতে ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিকল্প নেই। ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য বড় অন্তরায় হলো- আমাদের দেশে এ বিষয়ে অতো প্রচারণা নেই। দ্বিতীয়ত ডোনার নেই। এছাড়া আমাদের অর্থ নেই এবং সাপোর্ট নেই। দেশে নেতিবাচক প্রচারগুলো বেশি হয়। পজিটিভ অ্যাটিচ্যুড কোনো লেভেলে নেই, যার কারণে যে কোনো একটা প্রবলেমে এটা (ট্রান্সপ্ল্যান্ট) থেমে যেতে পারে। এটা সাকসেসফুল করতে সবার হেল্প লাগবে।’
কিডনি রোগীর জীবন রক্ষায় ২২ ধরনের আত্মীয় নিজের একটি কিডনি দিতে পারেন। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী, জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। এই তালিকার বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি সুযোগ নেই।