মোনায়েম সরকার
নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আর্থিক শৃঙ্খলা- অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ তার সামনে। মাহমুদ আলীর সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময়ের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও পরিচয়ের কারণে এটা বলতে পারি যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুল মানুষের ওপর গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেননি।
বৃহস্পতিবার শপথ নিয়ে রোববার প্রথম কার্যদিবসে সচিবালয়ে নিজের অফিসে তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তা সমাধান করতে হবে। অবশ্য তিনি এটাও বলেছেন যে রাতারাতি সব সংকট দূর করা যাবে না। বিষয়গুলো বুঝতে একটু সময় লাগবে।
মাহমুদ আলী বলেছেন, রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সময় দিতে হবে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয় একা করতে পারবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেছেন, অর্থ পাচার রোধে কাজ করা হবে। টাকার মূল্য কমে গেছে। সেটা নিয়েও কাজ করা হবে। এ বিষয়ে কী করা যায়, তা দেখা হবে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বাংলাদেশও এ কারণে ভুগছে।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা প্রসঙ্গে নতুন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অর্থনীতিতে সমস্যা আছে দেখছি, বোঝার চেষ্টা করছি, সমাধানেরও চেষ্টা করব; বসে থাকার মানুষ আমি নই।’
মাহমুদ আলী যে বসে থাকার মানুষ নন, তিনি যে কাজের মানুষ সেটা আমিও জানি। তিনি কোনো কোনো বিষয়ে অতি উৎসাহ দেখান না, তবে সমস্যার গভীরে গিয়ে তার টেকসই সমাধানের উপায় খোঁজা তার একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। তিনি যখন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তখনও পরিকল্পনা করেই দেশের স্বার্থে নানামুখী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন।
আবার শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ২০১৪-২০১৮ সময়কালে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি-কৌশলের কারণে সুফল পেয়েছেন। তিনি অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। যদিও চাকরি জীবন কেটেছে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে। একজন বাস্তববাদী কর্মমুখী মানুষ হিসেবে মাহমুদ আলী দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন, এতটুকু আগাম প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
সংবাদপত্রে অর্থমন্ত্রীর সামনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে : মূল্য স্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সংকট দূর ও রিজার্ভ বাড়ানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ : কোভিড-১৯ মহামারি কেটে অর্থনীতিতে গতি ফিরবে এমন প্রত্যাশাকে মাটি চাপা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। দেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি। দেখা দেয় ডলার সংকট। কমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
এসব সংকটের মধ্যে নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনাই তার জন্য বড় চাপ হিসাবে থাকবে।
এছাড়া অর্থবছর শেষ হতে এখনও ৬ মাস বাকি। এরই মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকৃত বাস্তবায়নের হার এখনো অনেক কম। গেল ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার ৩১ শতাংশ এবং এডিবি বাস্তবায়ন হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি।
অপরদিকে আইএমএফের শর্তানুযায়ী জুনে ২ হাজার ১১ কোটি ডলারের রিজার্ভ গড়ে তুলতে হবে। এমন অসমাপ্ত কাজগুলো তাকে শেষ করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন মাহমুদ আলী।
তার সবচেয়ে বড় কাজ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী মার্চে এক হাজার ৯২৭ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করা। ডিসেম্বর নাগাদ ছিল এক হাজার ৭৭৮ কোটি মার্কিন ডলার। এটি অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে থাকছে। এজন্য রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনা এবং বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। অর্থবছরের শুরুতে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধরে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সর্বশেষ ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে আসে। সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আর্থ-কূটনীতির কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের সব দেশের সরকারই এখন আর্থ-কূটনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশে দেশে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশের সরকারও সেটা যথার্থভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। সেজন্যই আর্থ-কূটনীতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এ লক্ষ্য অর্জনে একজন যোগ্য ব্যক্তির হাতেই পড়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষিত হলেও একজন কূটনৈতিক হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতোপূর্বে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। পাশ্চাত্যের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতি বিষয়ে তার ভালো দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে, বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে তিনি আরো বেশি ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন একেবারেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যে ঢেলে সাজানো হয়েছে। আর অর্থসংক্রান্ত বা বৈদেশিক ঋণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। অর্থনীতির বিষয়গুলোকে সম্মুখভাবে উপলব্ধি করা, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা থাকা এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে সেগুলোকে বাস্তবায়ন করা- এই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে বর্তমান অর্থমন্ত্রী যথেষ্ট যোগ্য। তিনি বিগত সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। সংসদীয় কমিটির আর্থিক বিভাগীয় কমিটিগুলোরও সদস্য ছিলেন তিনি। সুতরাং তিনি একজন কূটনৈতিক হলেও অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।
কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০২১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলার সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা বর্তমান পর্যায়ে আসা পর্যন্ত বিদায়ী মন্ত্রী সামাল দিতে পারেননি। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পশ্চিমাদের সঙ্গে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে সরকারের। বিশেষ করে পোশাক খাত নিয়ে ভীতি রয়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস রপ্তানি। আর প্রায় ৮১ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে পোশাক খাতের মাধ্যমে।
এই অবস্থায় যাকে অর্থমন্ত্রী করা হয়েছে কূটনীতির ক্ষেত্রে তার সুনাম আছে, সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো বুঝে কাজ করলে ভালো কাজের সুযোগ আছে। দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদ আলী। এই সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলার নিষ্পত্তি এবং ছিটমহল বিনিময় তার সময়েই হয়।
আগের অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল এবং তার অদক্ষতার কারণে অর্থনৈতিক সংকট আশানুরূপ সামাল দেয়া যায়নি। আশা করি নতুন অর্থমন্ত্রী আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। রিজার্ভ সংকট, ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি, রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে, পুঁজি পাচারের মতো বিষয়গুলো সামাল দিতে হলে কঠোর হাতে পদক্ষেপ নেয়ার সদিচ্ছা রাখতে হবে। তাবেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হবে।
সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অর্থনীতি একটি জটিল বিষয়। এটিকে সরলীকরণ করলে হবে না। আমরা কী পরিস্থিতিতে আছি, কোন দিকে যাচ্ছি এবং কী করবো এসব বিষয় তাৎক্ষণিকভাবে বলা সম্ভব নয়। আমি আমার অধীনস্থ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনে-বুঝে-শুনে কথা বলবো।’
আমরাও আশা করবো, মাহমুদ আলী, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিষয়ে কথা বলে নিজে এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না। জেনে বুঝে শুনে কথা বলার অঙ্গীকার রক্ষা করবেন এবং দেশের মানুষের অস্বস্তি দূর করবেন। তার মতো অভিজ্ঞ মানুষ অতিকথন দোষ থেকে মুক্ত থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। আমরা নতুন অর্থমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনার পঞ্চম মেয়াদের সরকারের সাফল্য কামনা করি।
লেখক : রাজনীতিবিদ, লেখক এবং চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।