প্রতিদিনের ডেস্ক
টানা শৈত্যপ্রবাহে স্কুল বন্ধ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘তালগোল’-এর প্রভাব পড়েছে জেলা পর্যায়েও। দিনের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলেও কোথাও কোথাও স্কুল-কলেজ খোলা। কোথাও আবার হাই স্কুল ও মাদরাসা বন্ধ থাকলেও খোলা রাখা হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়।
আবার কোনো কোনো জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ধারণা, স্কুল শুরুর সময় অর্থাৎ ১০টায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে থাকলে তবেই স্কুল বন্ধ রাখতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনের এমন তালগোল সিদ্ধান্তে শৈত্যপ্রবাহে কাহিল হয়েই স্কুলে ছুটতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা।
বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, শ্রীমঙ্গল, সীতাকুণ্ডের জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে, শীতে স্কুল বন্ধ নিয়ে অগোছালো সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা বলছেন, আলোচনা-সমালোচনার পরও ঠান্ডায় কাহিল হয়ে বাচ্চাদের স্কুলে ছুটতে হচ্ছে। এটা শিক্ষা প্রশাসনের জন্য চরম লজ্জাজনক।
জানা গেছে, তাপমাত্রা কত ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে স্কুল বন্ধ হবে, তা নিয়ে মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) একদিনে তিন দফা বিজ্ঞপ্তি দেয় মাউশি। প্রথম দফায় বলা হয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির নিচে নামলে সেই জেলায় স্কুল বন্ধ রাখা যাবে। দ্বিতীয় দফায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে মাউশি।
পরে সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তালগোল থেকে বেরিয়ে দিনের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলেই স্কুল বন্ধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনাই জারি করেছে। তাতে বলা হয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা যাবে। এরপর তারা আর এতে পরিবর্তন আনেনি।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তালগোলের এ প্রভাব পড়েছে তীব্র শীতের জেলা হিসেবে পরিচিত চুয়াডাঙ্গায়। জেলাটিতে বুধবার (১৭ জানুয়ারি) দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি। এ কারণে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) জেলার হাই স্কুল ও মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ভিন্ন নির্দেশনার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ যথারীতি ক্লাস চলছে। শীতের সকালে বৃষ্টিও হয়েছে জেলার বিভিন্ন জায়গায়। তা উপেক্ষা করেই স্কুলে ছুটছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
চুয়াডাঙ্গার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান বলেন, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামায় বৃহস্পতিবার জেলার সব হাই স্কুল ও মাদরাসা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। আর আগামী রোববার থেকে দুই শিফটের স্কুলগুলো কিছুটা দেরিতে শুরু হবে।
তবে জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আজ যথারীতি খোলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে ছিল। কিন্তু আমাদের (প্রাথমিকে) নির্দেশনা হলো—সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০-এর নিচে নামলে বন্ধ হবে। সেজন্য আমরা বন্ধ করিনি। হাই স্কুলের উনারা বন্ধ করেছেন।’
দিনাজপুরে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রিতে নামলেও কোনো পর্যায়ের স্কুলই বৃহস্পতিবার বন্ধ হয়নি। জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে আজ বৃহস্পতিবার জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
শৈত্যপ্রবাহে স্কুল বন্ধের বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম। তিনি , তারা ১১ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ছিল বলে জানিয়েছেন। আজকে তাপমাত্রা কত, তা খোঁজ নেওয়া হয়নি। তবে স্কুল খোলা রয়েছে, ক্লাস চলবে।’জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দিনাজপুরে মাঘের সকালে একটু শীত পড়েই। আমরা দেখি সকাল ১০টার সময় তাপমাত্রা কত হয়। তখন যদি কম দেখি সেটা উপর মহলে জানাবো। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পেলে স্কুল বন্ধ করে দেবো।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ উপজেলার হাই স্কুল, মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ বৃহস্পতিবার খোলা। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তফা আলম সরকার জানান, বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে ক্লাস বন্ধ করা হবে।
পাবনার ঈশ্বরদীতে বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার উপজেলার হাই স্কুল, মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খোলা। এ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান জানান, ভোরের দিকে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়েছে। তাই স্কুলে ক্লাস চলবে।
উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তিনি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানালে বন্ধ রাখবো। এখনো সিদ্ধান্ত পাইনি।
সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ উপজেলায় আজ সব স্কুলই খোলা। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দীলিপ কুমার জানান, সকালে ঠান্ডা বেশি থাকে। বেলা বাড়লে ঠান্ডা কমে যায়। এজন্য কিছু স্কুল সকাল ৯টায় শুরু হতো। সেগুলোতে এক ঘণ্টা পিছিয়ে সকাল ১০টায় ক্লাস শুরু করতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উল্লেখ করে উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, যে নির্দেশনা আমরা হাতে পেয়েছি, তাতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার কথা বলা আছে। তাই বৃহস্পতিবার ক্লাস চলছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুলচারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক আলপনা আকতার শীতের সকালে বৃষ্টির মধ্যে সন্তানকে স্কুলে নেওয়া নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তার সঙ্গে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘একে তো শীত, তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে। শুনলাম শীত বেশি পড়লে নাকি স্কুল বন্ধ রাখা হবে। বাচ্চাটার সর্দি-কাশি সারছেই না। এত শীতের মধ্যে ভোরে ঘুম থেকে তুলে ওকে স্কুলে পাঠানো খুবই কষ্টকর। এটা তো দুর্যোগ পরিস্থিতির মতো। কয়টা দিন ক্লাস না নিলেই ভালো হয়।’
তবে কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নবেজ উদ্দিন জানিয়েছেন, রাজারহাট আবহাওয়া অধিদপ্তরে লোক পাঠানো হয়েছে। ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত হলে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হবে।
এদিন বেলা পৌনে ১১টার দিকে দিনাজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নজরুল ইসলাম মোবাইল ফোনে জানান, তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রিতে নামার তথ্য পেয়েছি। এজন্য আলোচনা করে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি।
দিনাজপুরের ‘শিক্ষার খবর’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে ক্ষোভ জানিয়ে পোস্ট করেছেন আজিম উদ্দিন নামের একজন। তার ছেলে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী উল্লেখ করে তিনি ওই পোস্টে লিখেছেন, ‘স্কুল ১০টায় মানলাম। যারা গ্রাম থেকে শহরের স্কুলে যায়, তাদের এক-দেড় ঘণ্টা আগে রেডি হয়ে হাতে সময় নিয়ে বের হতে হয়। এই শীতে ৭টায় উঠে খাওয়া-রেডি হওয়া এটা বাচ্চার জন্য কতটা কষ্টকর তা সরকারের লোকজন বুঝবে না।’
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘নির্দেশনা সর্বশেষ যেটা দেওয়া হয়েছে, সেটাই সবাইকে অনুসরণ করতে হবে। আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালকরা এটা সমন্বয় করবেন। আমার তো মনে হয় না যে এতে তালগোল পাকানোর কিছু আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা অফিসার (সাধারণ প্রশাসন) আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘তাপমাত্রা নিয়ে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। সেটা তো কেটে গেছে। মাধ্যমিকে যে নিয়ম, সেটাই প্রাথমিকেও অনুসরণ করলেই হবে।’