প্রতিদিনের ডেস্ক
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ পেতে তদবির-দৌড়ঝাঁপে রীতিমতো মত্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেওয়ার সংস্কৃতিও বহুদিনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার চেয়ারটি বাগিয়ে নেওয়ার দৌড়ে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং-দ্বন্দ্বে জড়ানোর ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আওয়ামী লীগ টানা চার দফা সরকারে থাকায় এ দ্বন্দ্ব এখন দলটির অনুসারী শিক্ষকদের মধ্যেই বেশি। এক গ্রুপ থেকে উপাচার্য নিয়োগ পেলেই প্রতিপক্ষ গ্রুপ তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে নেমে পড়ছে আন্দোলনে। উত্তপ্ত থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ব্যাহত হচ্ছে উচ্চশিক্ষার পাঠদান। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ শীর্ষ পদে নিয়োগে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
জানা গেছে, ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রতি বছরের মতো এবারও বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চমকের সুপারিশ উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসিকে ‘অংশীদার’ করার একটি গাইডলাইন প্রণয়নের আহ্বান। এটি বাস্তবায়নে স্বতন্ত্র একটি কাঠামো প্রয়োজন হবে। এজন্য সরকারকে সংসদে বিল উত্থাপন করে তা পাস করাতে হবে বলেও জানিয়েছে ইউজিসি সূত্র।
ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের মতো পদে পাণ্ডিত্য রয়েছে এবং ভালো শিক্ষাবিদ- এমন শিক্ষকের নিয়োগ পাওয়া উচিত। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কেমন পাণ্ডিত্য ও প্রশাসনিক জ্ঞান রাখেন, সেটি তদারককারী সংস্থা হিসেবে ইউজিসিই সবচেয়ে ভালো জানে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘গেটকিপার’-এর ভূমিকায় থাকতে চায় ইউজিসি।
ইউজিসির এমন সুপারিশ প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্যরা। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি স্পষ্টতই ক্ষমতার ভাগ চাওয়া। তবে তারা এখনো সুপারিশ হাতে পাননি। পেলে আলোচনা করে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্যদের মতামত, স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করতে পারলে ইউজিসি কিংবা মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ থাকবে না। সেটিই নিশ্চিত করা অতি জরুরি।
ইউজিসি সূত্র জানায়, প্রতি বছর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারককারী এ সংস্থাটি। এবার ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষদিকে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে তা ছাপা এবং বাইন্ডিংয়ের জন্য ছাপাখানায় রয়েছে। দ্রুতই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ প্রতিবেদন তুলে দেবেন ইউজিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের উচ্চশিক্ষা, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষা-গবেষণা পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি শিক্ষা-গবেষণা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে প্রতি বছর কিছু সুপারিশ করা হয়। এবার যে সুপারিশগুলো করা হচ্ছে, তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের হস্তক্ষেপের সুযোগ চেয়েছে ইউজিসি।
ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ফাইলটি ইউজিসি ঘুরে যাওয়ার একটা নিয়ম করার ব্যাপারে সুপারিশ রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করলে উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে যে বিশৃঙ্খলা অনেক সময় হয়, সেটা কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে। এটি সরকার বাস্তবায়ন করবে কি না, তা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
উপাচার্য নিয়োগ চলছে যেভাবে
বর্তমানে দেশে ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলমান। এ দুটিসহ মোট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াবে ৫৭টি। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন অনুযায়ী, সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য নিয়োগের জন্য একটি প্যানেল গঠন করা হয়। সেটিই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী দপ্তর এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে চূড়ান্তভাবে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট অকার্যকর। ফলে প্যানেল গঠনও হয় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে পাঠিয়ে থাকে। পরে তা রাষ্ট্রপতি দপ্তর থেকে অনুমোদন হয়ে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়।
স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকা আরও অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয় স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় আইনে চলে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার আগ্রহী ও যোগ্য প্রার্থী খোঁজ করে। সেখান থেকে একাধিক শিক্ষককে বাছাই করে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের তালিকা পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী তার মতামত দেওয়ার পর ফাইলটি রাষ্ট্রপতি দপ্তর থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে আসে। অনেক সময় বড় ও পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে প্রেষণে তুলনামূলক নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
উপাচার্য নিয়োগে যে ‘ক্ষমতা’ চায় ইউজিসি
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়েও সিনেট অধিবেশন হচ্ছে না, প্যানেলও গঠন সম্ভব হচ্ছে না- ফলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় যোগ্য ও আগ্রহী শিক্ষকদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে তালিকা করছে। মন্ত্রণালয় এখন প্রাথমিকভাবে যে কাজটি করছে, সেটি করতে চায় ইউজিসি। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষককে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিলে ভালো হয়, সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে চায় ইউজিসি। তারা একটি পৃথক কমিটি গঠন করে দেবে। কমিটি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে।
জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেল (উপাচার্য পদে মনোনীত) কিন্তু আমাদের মাধ্যমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫-৭ জনের নাম পাঠানো হয়। আমরা তার মধ্য থেকে তিনজনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে একজন নিয়োগ পান। এ কারণে ওখানে (বেসরকারি) কিন্তু বিতর্ক কম হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারেও যদি এমনটা করা যায়, অনেকটাই ইউজিসি থেকে বাছাই হয়ে গেলে, সেটা আশা করি ভালো হবে।
ইউজিসি কেন এ পথে হাঁটতে চাইছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক কেমন, কার পাণ্ডিত্য কেমন, প্রশাসনিক দক্ষতা কতটুকু সেটি-তো আমরাই ভালো জানি। ফলে যোগ্যদের মনোনীত করতে কোনো গ্যাপ এখানে থাকবে না।
এ প্রক্রিয়া যদি সরকার চালু করে, তাহলে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট থেকে প্যানেল হয়ে এলে তাতেও ইউজিসি কি হাত দেবে? ফেরদৌস জামানের ভাষ্য, ‘না। সেটি সম্ভব নয়। তবে এখন ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগর ছাড়া কারও তো সিনেট হতে দেখি না। সেখানে মাঝে-মধ্যে ঝামেলা হয়। সিনেট হয়ে এলে সেটা সেভাবেই আমরা তখন ফরোয়ার্ড করবো। যেগুলোতে সিনেট নেই, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে আমরা খোঁজ খবর নেবো। যোগ্য-দক্ষ শিক্ষকদের খুঁজে বের করবো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন এখনো বাইন্ডিং শেষ হয়নি, কোনো দপ্তরেও যায়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট জানেন না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য এ নিয়ে করতে চাননি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন উপ-সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে মন্ত্রণালয়ের আমলারা চাইলেই কারও নামের তালিকা দিতে পারেন। মন্ত্রী ও সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে। সেভাবে আমরা কাজ করি, তালিকা পাঠিয়ে থাকি। সেখানে ইউজিসির যে সুপারিশের কথা (সাংবাদিকদের মাধ্যমে) শুনলাম, সেটা আননেসেসারি (অপ্রয়োজনীয়)।
মন্ত্রণালয়ের আরেকজন কর্মকর্তা নাম-পদবী প্রকাশ করা হবে না এমন শর্তে বলেন, উনারা (ইউজিসি) মনে করেন আমরা এক্ষেত্রে বেনিফিটেড (লাভবান)। সেজন্য তারাও হয়তো তাতে ভাগিদার হতে চাইছেন। সরকার যদি সেটা বাস্তবায়ন করে, তখন তারা বুঝতে পারবেন এটাতে মন্ত্রণালয়ের কতটুকু হাত থাকে।
গণতান্ত্রিক পন্থা-আইনে জোর দেওয়ার তাগিদ
উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসিকে গেটকিপার করার সুপারিশ নিয়ে বিব্রত শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্যরা। তাদের মতে, এগুলো টানাটানির চেয়ে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও গণতান্ত্রিক পন্থা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। তাহলে সব বিতর্কের অবসান ঘটবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টানা দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ইউজিসির সুপারিশ নিয়ে আমার মন্তব্য নেই। আমি বলবো, স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আইন আছে, তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে। সিনেট-সিন্ডিকেটসহ যেসব প্রশাসনিক বডি রয়েছে, সেগুলো সক্রিয় করে গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করা জরুরি। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে উপাচার্য প্যানেল করে দেওয়ার স্পষ্ট বিধান রয়েছে। সেটা কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেই পথে হাঁটতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানও একই মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু সীমাবদ্ধতা, বাধার কারণে সিনেট কার্যকর সম্ভব হয় না। সিনেটের প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়াও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মেয়াদকালেও আমি এটা করতে পারিনি। নানান রকম জটিলতায় পড়েছি।
সিনেট কার্যকর করতে বর্তমানে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক আব্দুস সোবহান বলেন, এ পথে হাঁটাটা সবচেয়ে ভালো উপায়।
অবসরপ্রাপ্ত এ অধ্যাপকের ভাষ্য, সিনেটের মাধ্যমে প্যানেল গঠন হয়ে গেলে সেটা আর ইউজিসি হয়ে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যে বিশ্ববিদ্যালয় নতুন এবং সিনেটে প্যানেল করার প্রক্রিয়া নেই, তাদের ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব পৃথক আইন দ্বারা পরিচালনা না করে একই আইনের আওতায় এনে গণতান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসক নিয়োগে উদ্যোগী হওয়াটাই হবে প্রকৃত সমাধান।