আলমগীর মিজান
আমার উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা খুব দীর্ঘ না হলেও সময় পেলেই পড়ার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১) থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯) হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮) পর্যন্ত আমার চেনা ভুবনের বিস্তৃতি। এই বটবৃক্ষদের রচনা পাঠের সঙ্গে তরুণ লেখকদের রচনাও আমার পাঠ্য। এরই ধারাবাহিকতায় জেমকন সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত সাজেদুল ইসলামের ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ উপন্যাসটি পাঠ্য তালিকায় যুক্ত করি। উপন্যাসটি পাঠ করে দীর্ঘদিন পর এক ভিন্ন অনুভূতি অর্জন করি– যা বলে বা লিখে পুরোপুরি বোঝানো অসম্ভব।
প্রথাগত সংজ্ঞায় বলা হয়, উপন্যাস হলো গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনি যার ভেতরে মানব জীবনের নানা চিত্র প্রতিফলিত হয়। যেকোনো বয়সী পাঠক উপন্যাসে একবার ডুবে গেলে তার রস আস্বাদন না করে ফিরতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, পাঠক যখন উপন্যাস পড়ে তখন অবচেতন মনে নিজের জীবনের সঙ্গে উপন্যাসের চরিত্রদের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে ফেরে। কাহিনির অভ্যন্তরীণ মানবীয় চিন্তা এবং পারিপার্শ্বিকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়না। মননশীল একটি উপন্যাস পাঠকের ভেতরে জীবনানুভূতি ও গভীর ভাবাবেগ তৈরি করে। ফলে পাঠকের মনোজগতে একটি চেতনাগত নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। কখনো কখনো তা রূপান্তর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ এই ফ্রেমের বাইরের উপন্যাস নয়। উপন্যাসটি পড়তে গেলে প্রথমেই এটি পাঠককে এক চিরায়ত দৃশ্যপটে নিয়ে যায়। দৃশ্যপটটি বাঙালি পাঠক মাত্রেরই পরিচিত। উপন্যাসে উঠে আসা পারিবারিক ও সামাজিক ঘটনার পরম্পরা এবং শ্লোক পাঠকের মনে হাজির করে নানা ঘটনার ঘনঘটা। বিশেষত শহুরে যান্ত্রিকতা ও কোলাহলের ভীড়ে ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ পাঠককে আদিগন্ত মাঠ পেরিয়ে নিয়ে যাবে সুদূরে কোথাও। যেখানে আছে চেনা-জানা পথঘাট, সরল মানুষ, মানুষের আদি-অকৃত্রিম বিশ্বাস এবং বিশ্বাসজাত নানা কর্মকাণ্ড। উপন্যাসে মানব জীবনের দৈনন্দিন সমস্যা, প্রেম, কাম, সামাজিক প্রেক্ষাপট, পরিবার, সংস্কার, মানবিক সংকট, ঘটনা-দুর্ঘটনা জাদুবাস্তবতার মিশেলে নানা ভঙ্গি ও কৌশলে উপস্থিত।
উপন্যাসের শুরুতে এক পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে আখ্যানালাপ। ভূমিকার আদলে লেখা এই আখ্যানালাপে উপন্যাসের পরিভ্রমণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আখ্যানের নায়ককে কেন্দ্র করে যারা আবর্তিত হয়েছে বা নায়ক যে চক্রটিকে সঙ্গ দিয়েছে– তাদের পুরো পরিসরটিকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে এক অলৌকিক সোনার নাও আর পবনের বৈঠা।’ উপন্যাসে বর্ণিত একটি মূল কাহিনির সঙ্গে একগুচ্ছ সম্পূরক গল্প ডালপালা মেলে দিয়েছে। গল্পের বাঁকে বাঁকে রয়েছে গান।
পাটুল জলের দ্যাশে আইলো
রঙিন জলের দিন
ভাসলো হাওয়ায় কলমিলতা
নৌকা কোষা-ডিঙ, আহা রঙিন জলের দিন
ভাসলো কৃষ্ণ মেঘগুচ্ছ
নাচলো নয়া মৎস্যপুচ্ছ
ভাসলো কত গাঙ
রঙিন জলের দিন দেখিয়া কেমন করে প্রাণ–
উপন্যাসের প্রয়োগকৃত প্রতিটি গানে রয়েছে লৌকিকতা ও লোকজ ভাবনার সমন্বয়। যা উপন্যাসে পাঠকের পরিভ্রমণকে আরো আনন্দময় করে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনোদিন সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। তবু আমরা তাদেরকে চিনি-জানি। অর্থাৎ ব্যক্তি লেখককে না চিনলেও লেখা পাঠের সুবাদে লেখককে চিনি। কিন্তু ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ এর লেখক সাজেদুল ইসলাম পূর্বপরিচিত হওয়ায় কিছু অসুবিধাতেও পড়তে হয়েছে। উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে রূপক, চিত্রকল্প ও কৌশলের বর্ণনায় লেখকের ব্যক্তি ইমেজও চোখের সামনে হাজির হয়েছে। এতে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও ঘটনার পরম্পরা থেকে সামান্য হলেও পাঠকের মনযোগে চ্যুতি ঘটে। ফলে উপন্যাসটি তার প্রকৃত মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হয়। এখানে ব্যক্তি সাজেদুল ইসলামকে সরিয়ে রেখে লেখক সাজেদুলকে চিন্তা করলে ভালো মূল্যায়নের দাবি রাখে ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’।
প্রকাশনা : কাগজ প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা ২০২৩
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য : ২২০