মোনায়েম সরকার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্য স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেই ভূমিকা পালন করবেন। ২৮ জানুয়ারি গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন পরামর্শই দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংসদে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে স্বতন্ত্র থাকায় লাভ আছে। কারণ, সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর সমালোচনা বা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরেন না। স্বতন্ত্র সদস্যরা এ কাজ ভালোভাবে করতে পারবেন। এতে দেশও লাভবান হবে।
জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সদস্যদের ভূমিকা কি হবে তা নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, তার একটি আপাত সমাধান হলো বলে মনে হচ্ছে। সংসদে বিরোধী দলের দুর্বল অবস্থানের কারণে সংসদ অকার্যকর বা প্রাণহীন হওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা কিছুটা দূর হওয়ার আশা এখন কেউ কেউ করতেই পারেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসছে আজ মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি)। এবারের সংসদে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের মধ্যে ৫৮ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তারা। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। সংসদে তাদের ভূমিকা কী হবে- এ নিয়ে আলোচনা চলছিল। স্বতন্ত্র এমপিরাও দলের বিপক্ষে থাকতে চান না। প্রায় সবারই দলে ফেরার ইচ্ছা।
এই প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র এমপিদের দলে বহাল থেকেই সংসদে স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা। ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গণভবনে স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদ নেতা। এ সময় দলীয় এমপিরা দলে ফেরার ইচ্ছার কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে। দলীয় প্রধানের কণ্ঠেও তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে। শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা সবাই আমার। ডান হাত, বাম হাত- দুই হাতই আমার।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন স্বতন্ত্র ৬২ জন সংসদ সদস্য। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের আগে সংসদ নেতার সঙ্গে বৈঠকে দলীয় ৫৮ জন সংসদ সদস্যের কণ্ঠেই ছিল একই সুর। তারা দলে ফিরতে চান। কারণ বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়াতে দলের কাউকে বাধা না দিয়ে উৎসাহিত করেছে আওয়ামী লীগ।
অনেক আসনেই নৌকার বিরুদ্ধে অন্য প্রতীক নিয়ে লড়াই করেন আওয়ামী লীগেরই নেতারা। ৪৬টি আসনে নৌকাকে হারতে হয় দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় এবং সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা ১১টিতে নামার পর সংসদে বিরোধী দল কারা হবে, এ নিয়েও দেখা দেয় প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করলেও সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। স্বতন্ত্র সদস্যরা সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ১০টি পাবেন। নারী সদস্য নির্বাচনের দায়িত্ব পেয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটা ভালোই হলো। এবার আরও বেশিজনকে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য করা যাবে। আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী পরিবার রয়েছে। অনেক নেতা অকালে মারা গেছেন। তাদের স্ত্রী-সন্তানরা আছেন। পেশাজীবীদের মধ্য থেকেও কাউকে কাউকে সংসদ সদস্য করা দরকার। এর মাধ্যমে ত্যাগীদের একটা স্বীকৃতি দেওয়া যাবে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় এলাকায় এলাকায় কিছুটা দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও সংঘাতের পরিবেশও তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলাকায় সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে হবে।
গাজীপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। নির্বাচন উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতেই আমরা অংশ নিয়েছি। আমরা তো আওয়ামী লীগেরই।
পিরোজপুর-২ আসনের এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চান। ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য খসরু চৌধুরী বলেন, এখানে যারা উপস্থিত ছিলেন প্রায় সবাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আমাদের গায়ে যদি এখনো স্বতন্ত্রের সিল থাকে, তাহলে দলের পদে থেকে কাজ করতে অসুবিধা হবে এবং এখনো হচ্ছে। মানুষ বিভিন্ন কথা বলছে।
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে একই বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, দলীয় সংসদ সদস্যরা যতটুকু কথা বলতে পারবেন, তার চেয়ে বেশি কথা বলার সুযোগ পাবেন স্বতন্ত্ররা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবেন। আপনারা সবাই আমার। আমার ডান হাতও আমার। আমার বাম হাতও আমার। সংসদের কার্যবিধি মেনে চলবেন। আর যে যে এলাকা থেকে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে এসেছেন, তাদের জন্য কাজ করবেন।
স্বতন্ত্র এমপিদের সামনে প্রারম্ভিক বক্তব্যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প দেশের মানুষের জন্য অর্থবহ, সেসব প্রকল্পই নেওয়া হয়। স্বতন্ত্র এমপিদের নির্বাচনী এলাকায় যদি কেউ ভূমিহীন, গৃহহীন থাকেন, তাদের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জনগণের ভোটে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করেছে। গণতন্ত্র সুদৃঢ় করেছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বাংলাদেশের ইতিহাস জানা এবং সংবিধান আত্মস্থ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংসদ কার্যপ্রণালি বিধি পড়তে হবে। আমাদের সংসদ ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ পার্লামেন্ট। কাজেই সংসদ প্র্যাকটিস ভালো করে জানতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় সংকট হলো, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক, দায়িত্বশীল একটি বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে যারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিতই হয়েছেন, তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর চাওয়াও অনেকটা সে রকম বলেই মনে হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র সদস্যদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের হয়েই থাকতে চান। ‘সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা আর খারাপ কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা’- স্বতন্ত্র সদস্যরা এই নীতি নিয়ে চললে সংসদীয় রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটতে পারে।
এবারও সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হচ্ছে। কিন্তু তাদের কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিতে বিরোধ আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পাল্টা কমিটি গঠনের মাধ্যমে জাপার বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দূরবর্তী ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি নিয়ে যদি বিরোধী দলের বিষয়টিকে বিবেচনা করা হয়, স্বতন্ত্রভাবে বিজয়ীরা যদি আলাদা অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশের জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ধারার জন্য ভালো হতো। একমাত্র শেখ হাসিনাই যে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন- এটা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন। সেজন্য পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনার দায়িত্ব আরও অনেক বেড়ে গেছে। একসঙ্গে অনেক কিছু তাকে করতে হবে। মানুষকে খুশি করতে হবে। জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। দুর্নীতি দমন করতে হবে। বৈষম্য কমাতে হবে। লুটেরা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুঁজি পাচার বন্ধ করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মোকাবিলা করে দেশে সম্প্রীতির ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে।
একই সঙ্গে দেশে একটি দায়িত্বশীল ও কার্যকর বিরোধী দল গঠনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের ভেতর জমে ওঠা আবর্জনা পরিষ্কারের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকেই দেশে একটি বিরোধী দল তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির আদর্শিক, কাঠামোগত ও কর্মসূচির ক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে এই দল যত দিন পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় আছে, তারা কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। কাজেই ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগকে বিএনপিকে মোকাবিলা করেই চলতে হবে। বিএনপি একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক দল। এই দলের সঙ্গে শুধু শক্তিপ্রয়োগের নীতি অনুসরণ করে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। মানুষের মন থেকে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করার উপযুক্ত কৌশলের কথাও ভাবতে হবে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে। মনে রাখতে হবে সরকার ও আওয়ামী লীগের ভুল বা দুর্বলতাই বিএনপির শক্তি। বিএনপিকে শক্তিহীন করতে হলে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে নির্ভুল পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।