প্রতিদিনের ডেস্ক
ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে চার বছর আগে হাত হারানো শিশুকে আদালত বললেন, ‘তুমি ভালো করে পড়ালেখা করবে। খেয়াল রাখবে।’এসময় শিশু নাঈম হাসান বলল, ‘অবশ্যই।’ তখন আদালত আবার বললেন, ‘আমি যখন বুড়ো হবো, তখন এসে দেখা করো। বলিও পড়াশোনা করে কত দূর গিয়েছ।’ শিশুটি জবাবে বলে, ‘জি।’আদালত বলেন, ‘এসো, চকলেট নিয়ে যাও, তোমাকে দিচ্ছি, আর কাউকে নয়।’
এরপর শিশুটি এজলাসের দিকে (বিচারপতির আসন) গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার তার হাতে চকলেট তুলে দেন।শিশুটির মুখে মিষ্টি হাসি। তখন এজলাসের ঘড়িতে বেলা ১১টা ছুঁই ছুঁই। আদালতকক্ষে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আবেগঘন পরিবেশ।
শিশু নাঈম হাসানের হাত হারানোর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে এর আগে বুধবার (৩১ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সিদ্ধান্ত দেন।
আদালতে আজ বিনা ফিতে (বিনা পারিশ্রমিকে) রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক ও অ্যাডভোকেট মো. বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তামজিদ হাসান।
ওয়ার্কশপ মালিকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট আবদুল বারেক। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত।
হাইকোর্ট শিশুটির নামে ১৫ লাখ টাকা করে ১০ বছর মেয়াদে চলতি বছরই (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে) দুটি ফিক্সড ডিপোজিট (এককালীন স্থায়ী আমানত) করতে কারখানার মালিককে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুটির পড়ালেখার খরচ হিসেবে প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা করে শিশুর ব্যাংক (আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, যাত্রাবাড়ী শাখা) হিসাবে মালিকপক্ষকে জমা দিতে বলা হয়।
রিট নিষ্পত্তি করে আদালত যখন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছিলেন, শিশুটির বাবা নিয়ামুল হোসেন আনোয়ার তখন আদালত কক্ষের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রায় ঘোষণা শেষে তার চোখে জল দেখা যায়। এর আগে সকালে মা–বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আদালতে আসে ১৩ বছর বয়সী নাঈম হাসান।
‘ভৈরবে শিশুশ্রমের করুণ পরিণতি’ শিরোনামে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন নাঈম হাসানের বয়স ১০ বছর। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। তার বাবা আনোয়ার হোসেনের পেশা জুতার ব্যবসা।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন আনোয়ার। এসময় সংসারের চাপ সামলাতে নাঈমকে তার মা-বাবা কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি ওয়ার্কশপে কাজে দেন। এ কাজ করতে গিয়ে তার ডান হাত ঢুকে যায় মেশিনে। পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় হাত।
প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিশুটির বাবা হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারির আদেশ দেন। রুলে শিশুটিকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
একই সঙ্গে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনা নিজ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা দিয়ে অনুসন্ধান করতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। আগের ধারাবাহিকতায় ৫ ডিসেম্বর রুলের ওপর শুনানি হয়। আদালত রিট নিষ্পত্তি করে আজ সিদ্ধান্ত দেন।
এ বিষয়ে আইনজীবী মো. বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘১৫ লাখ টাকা করে শিশুটির নামে ১০ বছর মেয়াদি দুটি ফিক্সড ডিপোজিট করতে কারখানার মালিককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একটি চলতি বছরের এপ্রিলে ও অন্যটির জন্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা করতে বলা হয়েছে। ১০ বছর পর মুনাফাসহ এই টাকা শিশুটি তুলতে পারবে, এর আগে নয়।
এছাড়া আগামী মাস থেকে শিশুর পড়াশোনার জন্য প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা করে মালিকপক্ষকে দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি চলমান তদারকিতে থাকবে বলেছেন আদালত। নির্দেশনা বাস্তবায়নবিষয়ক অগ্রগতি জানিয়ে তিন মাস পর পর আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়।
রিট আবেদনকারী পক্ষ জানায়, ওই ঘটনায় নাঈমের চাচা শাহ পরান বাদী হয়ে জবরদস্তিমূলক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগিয়ে আহত করার অভিযোগে ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর ভৈরব থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় ওয়ার্কশপের মালিক ইয়াকুব হোসেন, ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি স্বপন মিয়া, জুম্মান মিয়া, সোহাগ মিয়া ও ব্যবস্থাপক রাজু মিয়াকে। এ মামলায় ২০২১ সালের ৩০ মে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
মামলাটি চালানো হবে না জানিয়ে আইনজীবী মো. বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে একপক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে আর কোনো আইনি কার্যধারা নেবে না বলে রায়ে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, নাঈমদের পরিবার যে ভবনে ভাড়া থাকত, সেই ভবনের মালিক ওই এলাকার ইয়াকুব হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তি। ওই এলাকাতেই ইয়াকুব হোসেনের নূর ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি ওয়ার্কশপ রয়েছে। বাড়ির ভাড়াটে আনোয়ার হোসেনের পরিবারের দুরবস্থা দেখে নাঈমকে তার ওয়ার্কশপের কাজে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি কথা দেন, নাঈমকে দিয়ে কোনো ভারী কাজ করাবেন না। শুধু চা আনা আর ঝাড়পোছের মতো হালকা কাজ করানোর প্রস্তাব দেওয়ায় রাজি হয়ে যান আনোয়ার-মনোয়ারা দম্পতি। এরপর প্রথম রমজানে কাজে যোগ দেয় নাঈম।
নাঈমের পরিবারের দাবি, শুরুর দুই মাস নাঈমকে দিয়ে হালকা কাজই করানো হতো। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকে নাঈমকে ড্রিল মেশিন চালানোর কাজে যোগ দিতে বলেন ইয়াকুব। রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। পরে বাধ্য হয়ে নাঈম ড্রিল মেশিনের কাজে হাত লাগায়। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে নাঈম দুর্ঘটনার শিকার হয়। এসময় ড্রিল দিয়ে মোটা পাইপ কাটার সময় মেশিনে তার ডান হাত ঢুকে যায়। শেষে শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।