২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

‘দুর্নীতিই বাংলাদেশকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না’

প্রতিদিনের ডেস্ক
রিজার্ভ সংকট তীব্র হচ্ছে। করোনার মহামারিকালে ৫০-এর ঘর ছুঁয়ে আসা রিজার্ভ এখন ২০-এর কোটায়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়েও আসছে ধাক্কা। বৈদেশিক বিনিয়োগও কমছে। টাকার মান হু হু করে কমছে ডলার সংকটের কারণে।
কী ঘটছে রিজার্ভে? কারণ কী, সমাধানের উপায়ই বা কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে মতামত গ্রহণ করা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের।তিনি মনে করেন, ‘সহসাই রিজার্ভ সংকট কাটছে না। বরং পলিসির পরিবর্তন করতে না পারলে এবং ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে রিজার্ভ পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।’
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও বুঝতে পারেন। ডলার সংকটের কারণে আমদানি করতে পারছেন না। বিল পরিশোধ করতে পারছেন না।’
‘মূলত রপ্তানি আয় আগের মতো আর আসছে না। রপ্তানিতে আমরা আসলে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হারও কমে গেছে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করি। কারণ এক্ষেত্রে তারা স্থির থাকতে পারেনি। রেমিট্যান্সের ওপর যে প্রণোদনা ধার্য করা হয়, তা দিনে দিনে বদলায়। এটি কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।’
একই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৈধভাবে যে টাকা আসছে তার চেয়ে বেশি টাকা আসছে বা যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। ভোগান্তি ছাড়া বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চট করে টাকা পাঠাতে পারছে। বড় একটি টাকা ব্যাংকের বাইরে লেনদেন হচ্ছে।’
তৃতীয়ত, বৈদেশিক বিনিয়োগ না বাড়া। টেনশন রেখে কেউ বাইরে থেকে এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে না। ব্যাংক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিদেশিদের নিরুৎসাহিত করছে। কে অন্যের পেছনে ঘুরে ঘুরে এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে?
আসলে আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন ঘাটতি বলে মনে করি। আপনি একটি উদাহরণ দিয়েই সব বুঝতে পারবেন। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছ থেকে বছরে কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব বের করুন। চমকে উঠবেন! আর বিমান বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে।’
‘সরকার তো অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সেখান থেকে কী ফল আসছে? কথার কথা দিয়ে আসলে অর্থনীতি চলে না। অর্থনীতি চলে হিসাবের মাধ্যমে। আমরা পোশাক শিল্প থেকে বের হতে পারছি না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন্য জায়গায় আনতে পারছি না। এগুলো চলতে থাকলে তো রিজার্ভ সংকট দূর হবে না।’ বলছিলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সামনের দিনে সংকট বাড়বে না কমবে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সংকট বাড়বে কি না তা বলা না গেলেও খুব দ্রুত এর সমাধান হবে, তা বলা যাবে না। সরকারের লোকজন যা বলছে, তা অবাস্তব। মার্চের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার ভিত্তি কী? এত দিনে পারছে না কেন? কী এমন উদ্যোগ নিলো যে এক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে! রাজনৈতিক ভাষা দিয়ে এসবের সমাধান হয় না।
গোটা বিশ্বেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমরা তো পশ্চিমা বাজারও হারাতে পারি। শ্রম আইন ও অধিকার নিয়ে তারা বারবার বলে আসছে। আমরা এখনো ঠিক করতে পারিনি। কী ঘটবে সামনে তা কি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে? তাহলে সরকারের লোকজন কীভাবে বলছে যে সংকট দূর হবে?
আপনি এক জায়গায় সংকট রেখে আরেক জায়গা ঠিক করতে পারবেন না। রাজনৈতিক বক্তব্য মঞ্চে মানায়। মানুষ আর এসব শুনতেও পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের জীবন তো ঠেকে গেছে। উপায় বের করা দরকার।’
করণীয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক ক্ষমতা। আমি নিজেও জানি। কিন্তু বাস্তবায়ন না থাকলে সে ক্ষমতা দিয়ে কী লাভ? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলছেন, আমি কোনো প্রেশার অনুভব করি না। এসব বাজে কথা। চাপ না নিলে ব্যাংকব্যবস্থা চলবে কীভাবে? রাজনৈতিক চাপ থাকলে অন্য চাপ নেওয়ার সময় কই?
আমরা বিকল্প পথ বের করার পরামর্শ দিচ্ছি।’
‘পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। আগের নিয়মে চলবে না। কৃষিপণ্যের ওপর আমাদের গুরুত্ব নেই। কৃষককে ভর্তুকি না দিলে সাধারণ মানুষকে বাঁচানো যাবে না। চামড়া শিল্প নিয়ে আমাদের অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল। পারিনি। চা, সিরামিক, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য রপ্তানি করার সময় এখন। নজর নেই। প্রণোদনা নেই। সব প্রণোদনা মিলছে পোশাক খাতে। কোনো কারণে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে রপ্তানি আয়ের কী ঘটবে? পোশাক খাত তো দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা অন্য খাত নিয়ে এখন ভাবছি না কেন? কোন দেশ একটি পণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে রপ্তানি আয় করে? মোট কথা পোশাক কারখানার মালিকদের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি, যা বলে সরকার তাই করে।’
‘দুর্নীতিই বাংলাদেশকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না। দুর্নীতির কষাঘাত পড়ে প্রথমে সাধারণের ওপর। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। যে রেমিট্যান্স আসছে, সেই পরিমাণ টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে বাইরের এজেন্টরা টাকা পাচারে সহায়তা করছে। সরকার জানে কীভাবে হচ্ছে। কিছুই জানে না এটি বলার সুযোগ নেই।’
সুশাসন ও জবাবদিহিতা না থাকলে একটি সমাজে সব কিছুই বৈধতা পায়। সবাই আখের গোছাতে ব্যস্ত। মার খায় সাধারণ জনগণ। রিজার্ভ সংকটে টাকার মান কমছে। টাকার মান কমলে মূল্যস্ফীতি হয়। দ্রব্যের মূল্য বাড়লে ধনীর ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। আঘাতটা আসে প্রথমে গরিব মানুষের ওপর। সহজ হিসাব।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়