মোনায়েম সরকার
নির্বাচনের আগেও যেমন তেমনি পরেও আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর ভর করে এখন চরম হতাশার মধ্যে আছে বিএনপি। কয়েকটি দেশ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ায় বিএনপি ভেবেছিল, শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঠেকায় কে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠি বিএনপিকে চরমভাবে হতাশ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা এবং অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে ‘প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধনে জো বাইডেন লিখেছেন, ‘উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য আমাদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এবং আরো অনেক কিছুতে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমার প্রশাসনের আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করছি। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে কাজ করার ‘দীর্ঘ ও সফল’ ইতিহাস রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, দুদেশের জনগণের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধনই এই সম্পর্কের ভিত্তি।’
সম্প্রতি নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নাম করে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল। এরই মধ্যে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চমবার ও টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এরপরে সরকারও গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পরদিন থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তারপরও কেউ কেউ ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠি আসে। এই চিঠির মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছে, ওয়াশিংটন-ঢাকার মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ইতি ঘটল।
বাহ্যত যে যা-ই বলুক, সত্য সম্ভবত এটাই যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক বোঝাপড়া আছে। দুই দেশের স্বার্থেই এই বোঝাপড়া। এ কারণেই দিল্লিতে হওয়া জি-২০ সম্মেলনে দুই নেতা সেলফি তুলেছিলেন। বিশ্লেষকরা একে ‘সেলফি কূটনীতি’ নামেও অভিহিত করেছিলেন।
এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন,বিএনপি যদি তাদের রাজনীতি চাঙ্গা করতে চায়, তাহলে তাদের নেতৃত্ব বদল করতে হবে। না হলে আগামীতেও বিএনপিকে পথে পথেই ঘুরতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বিএনপিতে নেতৃত্ব বদলানোর বিষয়টি আওয়ামী লীগের ভাবনায় আছে। এই লক্ষ্য পুরো সফল হয়নি ক্ষমতাসীনরা। নেতৃত্ব বদলিয়ে বিএনপি যদি শক্তিশালী দল হতে চায় তাহলে সহযোগিতা করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু অযথা মাঠ গরম করতে চাইলে বাধা দেওয়া হবে।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব থেকে বিএনপিকে বের হওয়ার তাগিদ এখন নানা মহল থেকেই দেওয়া হচ্ছে। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পক্ষ থেকেও ইতিমধ্যে নেতৃত্ব বদলানোর দাবি উঠেছে।
তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাই বিএনপির শক্তি। যেহেতু বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দলটির নেতৃত্বের সমালোচনা শুরু হয়েছে, তাই তাদের নেতৃত্ব বদলানোর সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলেও তারেকের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারেকের কারণেই সুবিধা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারেক প্রশ্নে বিদেশিদের অবস্থান আর আওয়ামী লীগের কৌশল- এই দুইয়ে মিলে তারেকের নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবে না বলেই মনে করা হয়।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুরোদমে দল পুনর্গঠন কাজ শুরু করেছিল বিএনপি। সেই সময় মূল দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি হালনাগাদের উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। ওই উদ্যোগের পর মাত্র ২০টির মতো জেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৮২। এর মধ্যে মাত্র ১০টিতে মূল কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার আংশিক। ৫২টি জেলা কমিটি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। বাকিগুলোর হালনাগাদ তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ৫০টির বেশি জেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে পাঁচটি। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি, উপদেষ্টা ১৫টি, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকসহ প্রায় একশর মতো পদ শূন্য হয়ে আছে। তাছাড়া শারীরিক অসুস্থতার কারণেও কেউ কেউ নিষ্ক্রিয়।
আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি দুটি সহযোগী ও ৯টি অঙ্গসংগঠন। তবে এগুলোর সাংগঠনিক অবস্থাও বেহাল। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল গঠনতান্ত্রিকভাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠন। আর অঙ্গসংগঠন হিসেবে রয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, জাসাস ও মহিলা দল। এসব সংগঠনের মধ্যে কয়েকটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও বেশিরভাগের মেয়াদ নেই। সবচেয়ে করুণ দশা শ্রমিক দল, ছাত্রদল, মহিলা দল ও জাসাসের। তৃণমূল পর্যায়ে অধিকাংশ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। মাঝেমধ্যে কমিটি করতে গেলে বিশেষ ‘সিন্ডিকেট’ তাতে হস্তক্ষেপ করায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময়েও জেলা শাখা ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মী দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব থেকে বিএনপিকে বের করার বিষয়টি আওয়ামী লীগেরও লক্ষ্য বলে গণমাধ্যমেও খবর বের হচ্ছে। ক্ষমতার চলতি মেয়াদের প্রথম বছরেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে বার্তা দেওয়া হবে তারেকের নেতৃত্ব থেকে দলটিকে বের করার। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে বলা হবে, রাজনীতিতে টিকতে হলে, রাজনীতি করতে হলে নেতৃত্ব বদল করতে হবে। না হলে তাদের বিলুপ্তির পথে হাঁটতে হবে। মনে রাখতে হবে, নেতৃত্বের দুর্বলতা বা হটকারিতার কারণেই অনেক জনপ্রিয় দল বিলীন হয়ে গেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপির তৃণমূলের নেতারা দলের ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দায়ী করে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে বিএনপির তৃণমূল শীর্ষ নেতাদের দোষত্রুটির ব্যাপারে আরও সরব হবে। না হলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ওপর হতাশা ভর করবে। তখন এর সুযোগ নিতে পারে আওয়ামী লীগ। মাঠের রাজনীতিতে আরও দুর্বল করে কর্মীনির্ভর এই দলের কর্মীদের আরও হতাশ করার চেষ্টা করা হবে। আগামী পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনীতিতে বিএনপিকে আরও দুর্বল যে করতে পারবে তার লক্ষণ স্পষ্ট।
কৌশলে আওয়ামী লীগ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠনও করেছে। নির্বাচনের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অসুস্থতার মধ্যেও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নেতাকর্মীদের কাছে খবরাখবর নিয়েছেন। আন্দোলন সফল না হওয়ায় তখন ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন তিনি।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ফিরেছেন। ওইদিনের পর দলের কোনো নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে যাননি বা তিনি তাদের দেখা করতে দেননি। ফলে দলের সাধারণ নেতাকর্মী, দেশের সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, খালেদা জিয়া কি তাহলে একেবারেই নিভে গেছেন? সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন, খালেদা জিয়া কি আর রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে পারবেন না? এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে গৃহবধূ থেকে ‘আপসহীন’ নেত্রী হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার জীবন কি অস্তাচলে যেতে বসেছে?
বলা হচ্ছে, আপাতত খালেদা জিয়ার শারীরিক সুস্থতাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপির নেতারা। প্রকাশ্যে তারা বলেন, খালেদা জিয়াই দলের এবং সরকারবিরোধী রাজনীতির ‘ঐক্যের প্রতীক’। তবে দলের অনেকে মনে করেন, আবার জেলে যাওয়ার মতো অবস্থায় খালেদা জিয়ার নেই। আবার দলের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার সুযোগও তার নেই। ‘নেই’ হয়েই তিনি আছেন।
বিদেশে না যাওয়া ও নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া এ দুই শর্তে কারাগার থেকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। তখন থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে রয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে দেশে ফিরে দুর্নীতির মামলা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তাকে কারাগারে যেতে হবে এটা ভাবেননি দলের শীর্ষ নেতারা। তাদের ধারণা ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এখন তিনি বাসায় এবং রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়।
খালেদা জিয়ার নিষ্ক্রিয়তা, তারেকের ভার্চুয়াল একতরফা হুকুমনামা বিএনপিকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের পরিবর্তন এনে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় না ফিরলে রাজনীতিতে বিএনপি আর কোনো সুখবর তৈরি করতে পারবে না। দলটি হয়তো টিকে থাকবে কিন্তু লাঠিভর করে হেঁটে চলা বৃদ্ধের মতো, দৌড়াতে পারবে না আর।
লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।