আব্দুল আলিম, সাতক্ষীরা
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় ফসলি জমিতে বেড়েই চলেছে ইটভাটা। ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে তিন ফসলি জমি। জেলা সদরসহ সাতটি উপজেলায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে, যার ৭০ শতাংশই স্থাপিত হয়েছে ফসলি জমিতে। এসব ভাটার অধিকাংশের নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। নেই কোন সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় উচ্চ আদালতে রীট করে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাটা। মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিষেশজ্ঞদের দাবি, ফসলি জমিতে যে হারে ইটভাটা স্থাপন হচ্ছে তাতে পরিবেশ যেমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তেমনি মাটির উর্বরতা হারিয়ে ফসলহানির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। ফসলি জমি রক্ষায় ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে বলেও মনে করেন তারা। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাতক্ষীরায় ৯৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ঝিকঝাক ভাটা ৮৩ টি এবং সনাতনী পদ্ধতির ভাটা রয়েছে ১৩টি। এসব ভাটার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই ৬৭টি ভাটার। ছাড়পত্র আছে মাত্র ২৯টি ভাটার। পরিবেশের ছাড়পত্র বিহীন এসব অবৈধ ইটভাটার কোন সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই। শুধুমাত্র উচ্চ আদালতে একটি রিটের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাট। উচ্চ আদালতে রীট করার কারণে পরিবশে অধিদপ্তর অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কয়েকটি ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ইটভাটা ফসলি জমি ও জনবসতি এলাকায় স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার দহকুলা এলাকায় সানি ব্রিক্স, বেতলা গ্রামে এসবি ব্রিক্স, ছয়ঘরিয়া গ্রামে ঠিকানা ব্রিক্স, স্টার ব্রিক্স ও জেলা ভাটামালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রেজাউল সরদারের মালিকানাধীন নুনগোলা গ্রামের জনবসতি এলাকায় স্থাপিত মেসার্স এম.আর.এস ব্রিকস। এসব ভাটার একেকটি ৩০-৩৫ বিঘা জমি দখল করে রেখেছে। ভাটার চারিদিকে রয়েছে বোরো ধান, সরিষা, আম, কলাসহ বিভিন্ন ফলের বাগান। এ প্রসঙ্গে সদর উপজেলার দহকুলা গ্রামের সানি ইটভাটার স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালেক বলেন, এখন থেকে প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। তখন কোনো আপত্তি বা সমস্যা হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখে শুনেই অনুমোদন দিয়েছেন। তাছাড়া নির্মাণকাজের জন্য ইট তৈরির প্রয়োজনও তো রয়েছে। তাহলে ইটভাটা করব কোথায়? আরো অনেকেই ফসলি জমিতে ইটভাটা করেছে। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শামছুন্নাহার রত্না বলেন, ইটভাটার কারণে ক্রমেই সাতক্ষীরায় ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। তাছাড়া জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেয়ায় উর্বরতা কমছে। এতে ফসলহানির শঙ্কা রয়েছে। সঠিকভাবে মাটি ব্যবহার করতে না পারলে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইটভাটা স্থাপনের আগে নির্ধারিত ফি দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, ইটভাটা স্থাপন করা হয় অনুৎপাদনশীল কৃষিজমিতে, অর্থাৎ যেখানকার মাটি কৃষিকাজের জন্য অনুপযোগী সে জমিতে। জমিটি হতে হবে অবশ্যই ফসলি জমি থেকে দূরে। কারণ কোনোভাবেই ইট বানাতে গিয়ে ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলা সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল বলেন, পরিবেশ আইন বা নীতিমালা না মেনেই সাতক্ষীরায় অনেক স্থানে ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। জেলায় অন্তত ৯৬টি ইটভাটা রয়েছে, যার ৭০ শতাংশই ফসলি জমি বা জনবসতি এলাকায় গড়ে উঠেছে। এতে পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে পড়ছে তেমন জমির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে, যা ফসলহানির কারণও বটে। সাতক্ষীরা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ রেজাউল ইসলাম জানান, আগামীতে যাতে ফসলি জমিতে নতুন কোনো ইটভাটা স্থাপন করা না হয়, সে লক্ষ্যে সমিতির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে যেসব ভাটা ফসলি জমির ওপর করা হয়েছে, তা সরিয়ে নদীর আশপাশে নেয়ার জন্য সরকারের কাছে সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ফসলি জমিতে স্থাপিত এসব ইটভাটা ফসল উৎপাদনে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলায় প্রতি বছরই বাড়ছে ইটভাটা। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টা বিবেচনায় এনে দ্রুত এসব ভাটা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষক নেতারা। সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, কৃষি সমৃদ্ধ জেলা সাতক্ষীরায় বারো মাসই বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু ফসলি জমি নষ্ট করে ইটভাটা স্থাপন কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। দ্রুত এসব ইটভাটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।