১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

সীমান্তে ডেরা, ঘরে-অন্তর্জালে ফাঁদ পাতছে অপহরণকারীরা

প্রতিদিনের ডেস্ক
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অপহরণ ও মানবপাচার চক্রের সদস্য গ্রেফতারের খবর প্রায়শই পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় অপরাধীদের নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, অপরাধী চক্রগুলো সীমান্তবর্তী এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলছে। আর সেখানে থেকেই ব্যক্তিগত গাড়িচালক, দোকানের কর্মচারী কিংবা গৃহপরিচারিকাদের মতো ‘কাছের লোকদের’ ব্যবহার করে ধনাঢ্য পরিবারের লোকজনকে টার্গেট করছে চক্রগুলো। শুধু তাই না, বিভিন্ন প্রলোভনে ফাঁদে ফেলছে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মেও। এসব চক্রের হাত থেকে বাদ পড়ছেন না নারী ও শিশুরাও।
সম্প্রতি অপহরণ ও মানবপাচারের চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর এমনই তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী টাঙ্গুয়ার হাওর, নেত্রকোণার কলমাকান্তা ও দূর্গাপুর এবং ভারতের মেঘালয়ের দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এসব সীমান্তে অপহরণকারী, চোরাকারবারিরা নিয়মিত যাতায়াত করছে। আর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এদের সহায়তা করছে গাড়িচালক, গৃহপরিচারিকার মতো ব্যক্তিগত কিছু ‘কাছের লোকজন’।
গত ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে শেরপুর যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান হিমেল। দীর্ঘ এক মাস তাকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার হুমকি দিয়ে কয়েক কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে আসছিল একটি চক্র। সবশেষ গত ২৪ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের দুর্গম পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয় হিমেলকে। গ্রেফতার করা হয় অপহরণ চক্রের মূলহোতাসহ ১২ জনকে।
হিমেল অপহরণের ঘটনায় তদন্তে নেমে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে, হিমেল অপহরণের মূল হোতা ছিল মালেক। তাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে হিমেলের গাড়ি চালক ছামিদুল ইসলাম।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, হিমেলের গাড়ি চালানোর সময় ছামিদুলের মনে লোভ জাগে, তার নিজেরও একটি গাড়ি থাকবে! ব্যবসায়ী বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সে অনেক টাকার মালিক হিমেল। সেই টাকা আত্মসাতের ভাবনা থেকে মালেক-চক্রের সঙ্গে অপহরণের পরিকল্পনা সাজায় ছামিদুল।শুধু এ ঘটনাই নয়, বিভিন্ন অপহরণ চক্রের সঙ্গে গাড়িচালকদের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি।
এদিকে এই অপহরণ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক মানবপাচার চক্রের সন্ধান দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনাক্রমে এই চক্রটির আস্তানাও সীমান্তবর্তী আরেক জেলা সাতক্ষীরা। এই চক্রটিও দীর্ঘদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নারী ও শিশুদের পাচার করতো। চক্রটির নেতৃত্বে ছিল সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার ভারতীয় সীমান্তের জিরোপয়েন্ট লাগোয়া গ্রাম কেরাগাছি এলাকার আব্দুল হামিদের দুই ছেলে আনারুল ও কবির হোসেন। আনারুল মূলত গরুর খামারের আড়ালে এই চক্রটি চালিয়ে আসছিল। আর কবির গাড়িচালকের বেশে চক্রের সংগ্রহ করা নারী ও শিশুদের পাচার করতো।
এ প্রসঙ্গে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘কাউকে বিশ্বাস করার আগে যাচাই-বাছাই করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, কেউ গৃহপরিচারিকা হিসেবে থাকে, কেউ আবার দোকানের কর্মচারী কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত থেকে এসব অপরাধে জড়িত হচ্ছে। তারা প্রথমে কিছুদিন ভালো আচরণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। পরে সুযোগ বুঝে অপহরণ, চুরি কিংবা ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটায়।’
ঘরের ভেতরের তথ্য ‘কাছের লোকেরাই’ দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাসার নিরাপত্তাকর্মী আছে, এছাড়া অন্যান্য কাছের লোকের সংশ্লিষ্টতা থাকে। হিমেলকে যারা অপহরণ করেছিল, তারা তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছামিদুলকে নিয়ে নাটক সাজাতে চেয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল ওই চালককে আবার হিমেলের পরিবারের কাছে পাঠানো। কোনোভাবেই যেন পরিবার বুঝতে না পারে সে এ ঘটনায় সঙ্গে জড়িত। সুযোগ পেলে আবার হয়তো কিছুদিন পরে এমন আরেকটা ঘটনা ঘটাতো।’ এটা অপহরণকারীদের নতুন কৌশল বলেও জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কেউ চাইলে তো কোনও ব্যক্তির তথ্য সহজে সংগ্রহ করতে পারে না। বড়লোকের সন্তানকে যখন অপহরণ করতে চায়, তখন তারা গাড়িচালকদের ব্যবহার করে গুরত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে। হিমেলের ক্ষেত্রেও অপহরণ চক্রটি গাড়ি চালক ছামিদুলকে টার্গেট করে। আর ছামিদুলেরও টার্গেট ছিল বড় লোক হওয়ার, তাই তারা সহজে তাকে ব্যবহার করতে পেরেছে।’
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর, কলমাকান্তা, দূর্গাপুর, মেঘালয় এসব দুর্গম এলাকায় আমরা সহজে যেতে পারি না। এই সুযোগে সন্ত্রাসীরা এখানে অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। সেখানে চোরাকারবারিদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। সীমান্তে দুই দেশের মোবাইল সিম অবাধে বিক্রি হচ্ছে। গরু, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এই মানুষগুলো কীভাবে ওপারে যাচ্ছে! তাই এখন এসব অঞ্চলে আমাদের নিয়মিত নজর রাখতে হবে। আর যারা বর্ডার এলাকায় কাজ করছে, তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে।’
গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সবাইকে বলবো, যারা ব্যক্তিগত গাড়িচালক নিয়োগ করেন। তাদের আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। কারণ, এই ঘটনায় আমরা ছামিদুলকে দেখেছি, তার মতো বহু চালক এসব অপহরণ চক্র ও সন্ত্রাসীদের কাছে তথ্য দিয়ে থাকে। গাড়িচালকরা পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে। এসব তথ্যের কারণেই অনেক ঘটনা ঘটছে।’

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়