সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার
‘হৃদয় দিয়ে খুঁজিও না লাভ বা ক্ষতি ঢের,
গুছাইয়া লও কারণ সে আসিবে না ফের।’
পারস্য কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের এই দুটো লাইনের মাঝে লুকিয়ে থাকা সাংঘাতিক এক সত্য আমাদের প্রতিটা ক্ষণে এক বিমর্ষ বালুকাবেলায় আছড়ে ফেলে। বাংলার বাউল ফকিরের মুখেও সেই একই কথা শুনি, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে।/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে’। এটা শুনলে মনের আকাশে যেন এক করুণ বিউগলের সুর বেজে ওঠে। সাথে সাথে অতি নিষ্ঠুর এক সত্যের দিকে মন ছুটে যায়, তাহলে জীবনের অর্থটা কী? এই অন্তহীন যাত্রার কী সে প্রাপ্তি! যদি শেষমেশ অর্থ নাইবা থাকে তাহলে, ‘কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা/ কোন শূন্য হতে এলো কার বারতা?’ জীবনের মানে খোঁজ করার চেষ্টা মানুষের আজন্ম। অনন্তকাল ধরে মানুষের মনের ভেতর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, জীবনের অর্থ কী? আমরা কেন বেঁচে আছি, কেন বাঁচতে হয়! অথবা কেন বাঁচতে হবে? কিং জোন-এ সেক্সপিয়ার বলছেন, ‘একজন তন্দ্রালু লোকের কানের কাছে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণের মতোই জীবন হচ্ছে একই গল্প দুবার বলার ন্যায় ক্লান্তিকর।’ অন্য এক জায়গায় ম্যাকবেথের মনের কথাগুলো এভাবে প্রকাশিত হয়েছে, ‘জীবন সে তো কোনো এক বোকার গল্প, যেটা কিছু শব্দ আর ক্রোধের সমাহার, যার অর্থ সবই অনর্থ।’
সত্যি এ জীবনের আদৌ কোনো অর্থ আছে নাকি অর্থহীন এক নিরর্থক স্বপ্নের ঘোরে মানুষ ছুটে চলেছে, এ প্রশ্ন গুরুতর। এ রকম এক অতি অপরিহার্য প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে গৌতম বুদ্ধ ঘর ছেড়েছিলেন এক অলঙ্ঘনীয় সত্যের আশায়। তিনি বুঝেছিলেন দুঃখ ছাড়া জীবনের কোনো মানে নেই। সমগ্রতা বাদ দিয়ে ব্যক্তি মানুষের মুক্তির যে উদগ্র বাসনা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেটাই গৌতম বুঝেছিলেন অল্প বয়সে।
হাল আমলে যাকে আমরা উত্তর-আধুনিক চিন্তার সূত্রধর বলে জানি সেই জার্মান দার্শনিক ফেড্রিক নিটসে এই চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। কয়েকশ বছরের জার্মান চিন্তার অন্যতম এক কারিগর হিসেবে নিটসেকে মানুষ গ্রহণ করেছে, বর্জনও করেছে নেহাত কম মানুষ না! এই গ্রহণ-বর্জনের খতিয়ানের মধ্যেই আছে তাঁর দর্শনের অন্তর্নিহিত পর্চা। ডেভিড হিউম ‘অন সুইসাইডে’ লিখেছেন, ‘এই মহাবিশ্বের কাছে একজন মানুষের জীবনের গুরুত্ব একটা ঝিনুকের থেকে বেশি নয়।’ এ ধরনের এক দার্শনিক আলোচনার একটা কেতাবি নাম হচ্ছে নিহিলিজম। পাশ্চাত্য চিন্তায় উনিশ শতকের এই দার্শনিক-প্রবর ফ্রেড্রিক নিটসকে নিহিলিজমের গুরু হিসেবে ধরা হয়। যদিও প্রাচ্যে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতকে গৌতম বুদ্ধ ছিলেন এর জনক। ভারতীয় দর্শন চিন্তায় এসেটিজম বা সন্ন্যাসবাদের একটা পাকাপাকি অবস্থান চিরকালই ছিল। যেমন শ্রী মদ্ভাগবতগীতার সাংখ্য যোগে বলা হচ্ছে, বিহায় কামান্ যঃ সর্বান পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ।/ নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।। (৭১) (অর্থাৎ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিষ্পৃহ, নিরহংকার ও মমত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করেন।)
এই সন্ন্যাসবাদ থেকে সাশ্রয়ীবাদ বা রিনানশিয়েশন হচ্ছে ভারতীয় দর্শন চিন্তার মুখ্য পটভূমি। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শন সুনিশ্চিতভাবে এই স্পিরিটের বিপরীতমুখী। অর্থাৎ পশ্চিম দেশে যখন একজন ব্যক্তি জীবনের অর্থহীনতার কথা বলেন, তখন বেশ খানিকটা খটকা না লেগে উপায় নেই। পাশ্চাত্যে জীবনের বিচ্ছিন্নতাকে নিহিলিজমের অংশ হিসেবে ধরা হয় যার মূল কারণ নিজের উৎপাদিত ফলাফল থেকে নিজে বঞ্চিত হওয়া। প্রাচ্যে এই ধারণা ভিন্ন। প্রাচ্যে নিহিলিজমের অর্থ আরও ব্যাপক। সেখানে বলা হচ্ছে, “বৃহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা”। আর যেহেতু ব্রহ্ম আকার বিহীন এক অরূপ সত্তা তাই সবকিছু শূন্য।
নিহিলিজমকে বাংলায় বলা হচ্ছে শূন্যবাদ বা ধ্বংসবাদ। প্রচলিত বিশ্বাস, ধারণা, মতামত, গতানুগতিক চিন্তার ওপর বিরাট একটা জিজ্ঞাসা তুলে দিয়েছে শূন্যবাদ। মানুষের জ্ঞান, নৈতিকতা আর অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে অর্থাৎ মানুষের অস্তিত্বের সকল বিন্দুতে নিহিলিজম প্রবেশ করেছে; বাতিল করেছে ভাবনার বিচিত্র সব চিরায়ত অনুষঙ্গ। নিহিলিজমের বিস্তৃতি তাই বিপুল—জ্ঞানতত্ত্বে, নৈতিকতায়, অস্তিত্বে অথবা দৈনন্দিন ভাবনায় এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এক কথায় নিহিলিজম দর্শনের একটা বিরাট ক্ষেত্রের ওপর ছায়া ফেলেছে আবশ্যিক ভাবে। জীবন যখন শুকায়ে যায়; তখন করুণ ধারায় আসতে অনুরোধ জানায় এক গীত সুধারসের। হয়তো এই শূন্যবোধেরই এক ফলাফল নিহিলিজম। মানুষ যখন এই মহাবিশ্বে বেঁচে থাকার একটা অর্থ গভীরভাবে খুঁজে পায়; তখন তার কাছে সবকিছু আনন্দময় হয়ে ওঠে। পৃথিবী তখন তার কাছে খুব অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন বলে ওঠে, “এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি-/ অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি/ এই মহামন্ত্রখানি,/ চরিতার্থ জীবনের বাণী।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কিন্তু নিহিলিজম পুরোপুরি এই আশাবাদের মাথায় জল ঢেলে দিয়ে বলে উঠেছে, “বলো না কাতর স্বরে বৃথা জন্ম এ সংসারে/ এ জীবন নিশার স্বপন,/ দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার কে তোমার/ বলে জীব করো না ক্রন্দন;/ মানব-জনম সার, এমন পাবে না আর/ বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন;/ কর যত্ন হবে জয়, জীবাত্মা অনিত্য নয়,/ ওহে জীব কর আকিঞ্চন।” (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)। আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে এক ধরনের হার না মানা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এক চরমতম সত্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছে নিহিলিজম।
নিহিলিজমকে অনেকে শূন্যবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আবার অনেকে এটাকে চরমতম নৈরাশ্যবাদ কিংবা গোঁড়া সংশয়বাদ হিসেবেও নামকরণ করে থাকেন। একজন নিহিলিস্ট আমাদের বিদ্রোহী কবির মতো হয়তো মনে করেন,
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান!
পশ্চিমা সমাজে বিশ শতকের সামাজিক অস্থিরতা নিহিলিজমকে মানুষের কাছে বেশি জনপ্রিয় করেছে। প্রচলিত সামাজিক প্রথা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, কিংবা জীবনের উদ্দেশ্যহীনতাকে নিহিলিজম দারুণভাবে একত্রিত করেছে। এর ফলে চিন্তার প্রায় সকল জায়গায় নিহিলিজম বিস্তৃত হয়েছে, যেমন সাহিত্যে, দর্শনে, ইতিহাসে, শিল্পকলায়, হারমেনিউইটিক্স অথবা নৃবিজ্ঞানের প্রতিটা শাখায়। ১৮৬২ সালে রাশিয়ান ঔপন্যাসিক আইভান টারজেনাভের “ফাদারস অ্যান্ড সন্স” উপন্যাসে নিহিলিজম শব্দের প্রথম দেখা মেলে। রাশিয়ান জনপ্রিয় এই উপন্যাসে চলমান সমাজ বাস্তবতা ও মানবিক সম্পর্ক নিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চিন্তার যে পরিবর্তন হয়েছে, তাকে একটা ভিন্ন মোড়কে উপস্থাপন করেছেন টারজেনাভ। মূলত বাবা ও ছেলের মধ্যে যে সময় ও চিন্তার ফারাক সেটা কিভাবে রাশিয়ার সমাজ বাস্তবতার ওপর প্রভাব ফেলেছে তাই বোঝাতে গল্পের চরিত্র জেভজেনি বাজেরভেরকে নিহিলিস্ট হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন আইভান টারজেনাভ।
মনে রাখতে হবে, তীব্র সংশয়ী চিন্তার সাথে নিহিলিজমের একটা ভাবগত সম্পর্ক আছে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে আমরা দেখেছি দার্শনিক ডেমস্থেনাস (c ৩৭১-৩২২ BC) যখন বলছেন, “আমি যা বিশ্বাস করতে চাই সেটা সব মানুষ বিশ্বাস করে”। এখানে জ্ঞানের একটা সাম্পর্কিক দিক উঠে আসে যাকে বলা হয়ে থাকে জ্ঞানতাত্ত্বিক শূন্যবাদ। জ্ঞানতাত্ত্বিক শূন্যবাদ এই জন্য যে সত্য ও জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই, যতটুকু আছে তা নড়বড়ে। উত্তর-আধুনিক চিন্তা যে এন্টি-ফাউন্ডেশনাল বা কাঠামোবাদ বিরোধী সেটা জ্ঞানের এই চলমানতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নিহিলিজমের বহুমাত্রিকতা আমাদের জীবনের সাথে দারুণভাবে মিশে আছে। জ্ঞানতাত্ত্বিক নিহিলিজম ছাড়াও আছে পলিটিক্যাল নিহিলিজম, এথিক্যাল নিহিলিজম, একজিস্টেন্সশিয়াল, নিহিলিজ্ ইত্যাদি। তবে সকল প্রকার নিহিলিজমের বক্তব্য একটাই,
ওমর খৈয়ামের কথায়,
ব্যাকুল হৃদি বৃথাই ঘুরে শান্তি কোথা মাগি,
চিরন্তণী প্রশ্ন রহে বিশ্বমনে জাগি;—
চিতার পারে, গোরের মাঝে—চক্রপাণির ডাকে
জীবন সে কি দিচ্ছে সাড়া মৃত্যু দুয়ার ফাঁকে!
প্রাচীন ও মধ্যকাল পেরিয়ে নিহিলিজমের আনুষ্ঠানিক যাত্রাপথ যার হাত ধরে প্রশস্ত হয়েছে তিনি জার্মান দার্শনিক ফেড্রিক নিটসে। জগৎ সম্পর্কে নিটসের উপলব্ধি ভীষণ রকম হতাশাব্যঞ্জক। সম্ভবত মানবতা ও মানবিক গুণাবলি তাঁর মতে সাংঘাতিক রকম অপদস্ত। অসুস্থ মানবতাকে মুক্তি দিতে এবং মানব জাতিকে সুস্থ করে তুলতে তিনি দর্শনের দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। জগতের দুরারোগ্যতা বিশ্লেষণ করতেই তিনি একান্তভাবে একজন নিহিলিস্ট হয়ে উঠেছেন। এ জগতের প্রধানতম সমস্যা কী? এই প্যাথলজির মূল কী? এই বিকারগ্রস্থতার কি কোন অরোগ্য আছে? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করার মধ্যেই নিটসে খুঁজে পেয়েছেন দর্শনের সারবত্তা। নিহিলিজমের শুরুতেই আমাদের মনে রাখতে হবে, নিটসে বলেছেন, “মূল্যবোধের বিভাজন নিজেদেরই অবমূল্যায়ন করে বসে”। কথাটা একটু বিশ্লেষণ করলে সহজ হবে বুঝতে। মূল্যবোধ কী? সাধারণভাবে আমরা জানি মূল্যবোধ বা নর্মস হচ্ছে একধরনের নীতি বা আদর্শ যা আমাদের জীবনকে পরিচালিত করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কিংবা দৈনন্দিন জীবনাচারকে নিয়ন্ত্রণ করে নীতি বা আদর্শ। নিটসে এটাকেই বলছেন, ভ্যালু। এই ভ্যালু আমাদের চিন্তার ভেতর এমনভাবে প্রবেশ করে আছে যা থেকে আমরা ভাগ করে ফেলি, “হাইয়ার ভ্যালু”, “লোয়ার ভ্যালু”। অর্থাৎ একটা ভ্যালু অনেক মূল্যবান, অন্যটা কম। ভদ্র মানুষদের হাইয়ার ভ্যালু অভদ্রদের লোয়ার। অর্থাৎ এই ধরনের বিভাজন ঘটালে প্রকারন্তে একটা ভ্যালু অন্যটাকে অবমূল্যায়ন করে ফেলে। এজন্যই নিটসে এই মূল্যবোধ বা ভ্যালু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই কথাটাই বলেছেন, পরম বা উচ্চ মূল্যবোধ আদতে নিজেদেরই ক্ষতি করে বসে। তথাকথিত চিরায়ত বিশ্বাসের ওপর কুড়াল দিয়ে সজোরে আঘাত করেছেন নিটসে। নিটসে তাঁর Will to Power গ্রন্থে বলছেন, “প্রতিটা বিশ্বাসই অর্ধ-সত্য”। সে কারণে মূল্যবোধের ওপর যে চাদর বিছানো ছিল সেটাকে তিনি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন। তিনি এই বইয়ে আরও লিখছেন, “Nihilism is … not only the belief that everything deserves to perish; but one actually puts one’s shoulder to the plough; one destroys”।
যা হোক নিহিলিজমে প্রবেশের আগে তাই নিটসে সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৮৪৪ সালের ১৫ অক্টোবর জার্মানির রকেনে নিটসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্ল লুডভিগ নিটসে ছিলেন একজন লুথারিয়ান ধর্ম যাজক ও শিক্ষক। মায়ের নাম ফ্রেঞ্জিস্কা নিটসে। ১৮৪৯ সালে নিটসের পিতার মৃত্যু হলে তাঁদের পরিবার নুরেমবার্গে দিদার কাছে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ১৮৫৬ সালে তাঁর দিদার মৃত্যু হয়। এই বাড়িটা এখন একটা জাদুঘর হিসেবে নিটসে স্টাডি সেন্টার হিসেবে সুরক্ষিত আছে। অতি বাল্যকাল থেকেই তাঁর জীবন নানান চড়াই উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। যেহেতু তাঁর বাবা একজন ধর্ম যাজক ছিলেন, সেজন্য পিতৃহীন নিটসেকে নুরেমবার্গের খুবই নামকরা আন্তর্জাতিক মানের স্কুল ফোর্টাতে ভর্তি করানো হয়। তিনি সেখানে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এই স্কুলেই তিনি বন্ধু হিসেবে পান পল ডিউসনকে, যিনি ছিলেন প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ। পল ডিউসন পরবর্তীতে ভারতীয় দর্শনের ওপর ব্যাপক গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেন। পল ডিউসন এক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দের বন্ধু হয়ে ওঠেন। জার্মান আরেক দার্শনিক আর্থার শোপেন হাওয়ারও ভারতীয় চিন্তার বিশেষ সমঝদার ছিলেন বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের। ১৯১১ সালে পল ডিউসন শোপেনহাওয়ার সোসাইটি নামে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে একাডেমিক এক্সেলেন্সের সুবাদে বেসেলে ক্লাসিক্যাল ফিললজির চেয়ারে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁর শিক্ষক ফেড্রিক উইলহেল্ম রিটসেল লেখেন, “সে ইচ্ছে করলে যা কিছু করার সক্ষমতা রাখে”। যা কিছু করার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর বিচরণের অধিকার। কবিতা, ভাষাবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চিন্তক ইত্যাদির বিস্তৃত গণ্ডির মাঝে তাঁর অবাধ বিচরণ। শোপেনহাওয়ার ও ফেড্রিক আলবার্ট লেঞ্জের ওপর ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। লিপজিগে থাকাকালে নিটসে সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে পান রিচার্ড ওয়েগনারকে। ১৮৭০ সাল অবধি দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত গাঢ় কিন্তু পরবর্তীতে চিরজীবনের জন্য ভেঙে যায়। রিচার্ড ওয়েগনার তাঁর পিতৃতুল্য হলেও বন্ধুত্ব ছিল সীমানাহীন। ওয়েগনারের সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগ নিটসের কাছেও সংক্রমিত হয়। ১৮৭০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল। ওয়েগনারের বিষণ্ণ সংগীত মাধুর্য নিটসেকে নিয়ে গেছে নিহিলজমের গভীরে। অবশ্য ওয়েগনারও ছিলেন শোপেন হাওয়ারে মুগ্ধ একজন ব্যক্তি। ১৮৭২ সালে নিটসে প্রথম বই লেখেন The Birth of Tragedy out of the Spirit of Music নামে। প্রাচীন গ্রিসের ট্রাজেডির সাথে মিউজিক যুক্ত করে ইতিহাসের নৈরাশ্যধারার এক অপূর্ব উপাখ্যান রচনা করেছেন এই গ্রন্থটাতে। তিনি মনে করেন, গ্রিক ট্রাজেডির মূল উৎস হচ্ছে সংগীত। ১৮৭০-৭১ সালে ফ্রাঙ্ক-প্রুসিয়ান যুদ্ধের দামামা যেমন সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন তাঁর মনে হয়েছে এই বিরাট নৈরাশ্যের সুড়ঙ্গের ভেতর আমরা প্রবেশ করেছি। যেমন করে গ্রিক ট্রাজেডি মাথায় রেখে কলম ধরেছিলেন সফোক্লিস কিংবা একিলিসের মতো কবিরা। ডায়নেশিয়ান ও এপোলনিয়ানের মাঝে যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজন সেটা তুলে ধরে নিটসে বলেন, জীবনটা এই দ্বৈতের হার না মানা এক যুদ্ধের পরিণতি।
১৮৭৬ সালের দিকে নিটসে কঠিন এক ব্যামোতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তীব্র মস্তিষ্ক প্রদাহ, চোখের যন্ত্রণা, সাংঘাতিক বিবমিষা, ডিমেনসিয়া ইত্যাদি ছিল লক্ষণ। ডাক্তার তাঁর এই রোগকে ম্যানিনজিওম্যাল ক্রাইসিস বা রেট্রো-অর্বিটাল মেনেনজিওমা হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েক বছর পর শারীরিক উন্নতি না দেখে চাকরি থেকে তিনি ইস্তফা দেন। তবে এর পরপরই তিনি স্বাধীনভাবে লিখতে শুরু করেন। ১৮৮১ সালে তিনি লেখেন Day Break। মানুষের নৈতিকতা ও তার মাঝের মনস্তত্ব নিয়ে লেখা এই বইটা ভীষণ সাড়া ফেলে সেসময়। এরপর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টিকারী যুগান্তকারী কিছু বই, যেমন The Gay Science, Thus Spoke Zarathustra, Beyond Good and Evil, On the Genealogy of Morality ইত্যাদি। পরবর্তী বছরগুলোতে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন, যেমন ইতালি, সুইজারল্যান্ড, সিসিলিসহ বেশ কিছু জায়গা। তাঁর অসুস্থতাকালে সহোদরা এলিজাবেথ The Antichrist এবং Ecce Homo প্রকাশ করেন। এর মধ্যে Ecce Homo হচ্ছে তাঁর অনেকটাই আত্মজীবনীমূলক সংকলন। নিটসে ১৯০০ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ম্যাথু আর্নল্ডের ডোভার বিচ ও নীটসে
ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ কবি ম্যাথু আর্নল্ডের “ডোভার বিচ”র কথা মনে পড়ছে। নিটসের থেকে একটু বড় ম্যাথু আর্নল্ড উনিশ শতকের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ডোভার বিচ রচনা করেন। সে সময়ের সমাজ বাস্তবতায় কিভাবে বিশ্বাসের দেওয়াল আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে তারই ভিন্ন কাব্যিক দ্যোতনা ডোভার বিচ। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসের কবি সফোক্লিস যেমন ইজিয়ান সাগরের পাশে বসে সমুদ্রের কান্নার ভেতর মানবতার সূর্য ডুবতে দেখেছিলেন; আর্নল্ডও তেমনি বিশ্বাসের ম্রিয়মানতা দেখেছেন স্রোতের ক্ষয়িষ্ণু ঢেউয়ের ভেতর। বিশ্বাসের ক্ষয়িষ্ণুতার সাথে সাথে ভেঙে পড়ছে মানুষের আস্থা, চিরায়ত মূল্যবোধ। যার হাওয়া লাগছে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান কিংবা মানববিদ্যার সাধারণ পাঠে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি আমাদের নিয়ে গেছে সংশয়ের বিচিত্র সমাঙ্গনে। আর্নল্ডের সাথে নিটসের চিন্তার খুব বেশি মিল না থাকলেও শেষ বয়সে আর্নল্ড একজন অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে যা বলেছেন তা বুঝি নিটসের চিন্তার অনেক বিষয়ের সাথে সমকেন্দ্রিক। (বিস্তারিত দেখতে চাইলে, Alan Kahan, Arnold, Nietzsche and the aristocratic vision. History of Political Thought, Vol, XXXIII, No.1, Spring, 2012, Paris, French.)
উনিশ শতকের জার্মান পণ্ডিত অসওয়ার্ল্ড স্পেংলারের খুব সাড়া জাগানো বই “দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট”-এ কিছু ভবিষ্যৎ আশঙ্কা দিয়ে অসওয়ার্ল্ড আলোচনা করেছেন। পশ্চিমা সভ্যতার অবনমন সম্পর্কে তাঁর ধারণা হলো প্রাচীন ও ঘুণে ধরা বিশ্বাস ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ছে; ধীরে ধীরে ক্ষয়ে চলেছে রাজনীতির ধারা আর শিল্পের পুরোনো আখরগুলো। তিনি আরও লক্ষ্য করেন, ফাউস্টিয়ান নিহিলিজম যেমন সকল আদর্শকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে, এপলিনিয়ান নিহিলিজম যেমন সবার সামনে চুরমার করে দিয়েছে সবকিছু, ভারতীয় নিহিলিজম যেমন নিজেকে নিজের থেকে অপসারণ করেছে; ঠিক তেমনি পশ্চিমা সমাজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে শুধু সামনে পড়ে আছে নিরাশার বালুচর। নিহিলিজমের উপর্যুক্ত তিন ফর্মেটই তাঁর মতে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সত্তাতাত্ত্বিক চিন্তাবোধকে শেষ করে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশ সম্ভবত এ ধরনের এক প্রান্তিক অবক্ষয়ের শেষ কিনারায়। অবশ্য অনেকেই এ ধারণার বিরুদ্ধাচারণ করে বলেছেন, নিহিলিজম পশ্চিমা দেশে এভাবে বিস্তৃত হয়নি। যদি হতো তাহলে শূন্যতা, নৈরাজ্য আর অসংগতিতে ভরে উঠতো গোটা পশ্চিম দুনিয়া।
শূন্যতা কি অবশ্যম্ভাবী?
জীবনের কোনো এক সময় কিংবা একাধিকবার হয়তো প্রত্যেকেরই মনে হয়েছে এ জীবন অর্থহীন। কাজেই এ জীবন টেনে নিয়ে লাভ কী? কোনো এক অলস মধ্যাহ্নে সুদূর দিগন্তে মিলে যাওয়া রেখার দিকে দৃষ্টি প্রলম্বিত করে কোনো এক সময় হয়তো মনে হয়েছেঃ
দূরে দীপ্তি দেয় ক্ষণে ক্ষণে
শেষ তীর্থ-মন্দিরের চূড়া।
সেথা সিংহদ্বারে বাজে দিন-অবসানের রাগিণী
যার মূর্ছনায় মেশা এ জন্মের যা-কিছু সুন্দর,
স্পর্শ যা করেছে প্রাণ দীর্ঘ যাত্রাপথে
পূর্ণতার ইঙ্গিত জানায়ে।
বাজে মনে–নহে দূর, নহে বহু দূর।
(সংসারের প্রান্ত-জানালায়)
আমেরিকান দার্শনিক Allan Pratt The Dark Side: Thoughts on the Futility of Life বইয়ে জীবনের এই অনর্থকতা নিয়ে কী চমৎকার আলচনাই না করেছেন! তিনি বলেন, এই নিরর্থকতার গভীর সার বুঝেছিলেন প্রাচীন গ্রিসের বহু দার্শনিক। সংশয়ী এমপ্লিডক্লিস বুঝেছিলেন, এই নশ্বর জীবন ফলত অ-জীবনের মতোই। হেগেসিয়াস অব সিরাইন ছিলেন খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের অতি আলোচিত এক দার্শনিক। পারমানাইডিসের ছাত্র সিরেনাইক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেগেসিয়াস মনে করতেন দুঃখই সব। সুখ হচ্ছে অতি অলীক ও অবাস্তব এক প্রত্যয়। সেক্সপিয়ার ম্যাকবেথের শেষ অংশে বলছেন,
Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadow, a poor player
That struts and frets his hour upon the stage
And then is heard no more; it is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.
নিহিলিজম দুঃখবাদের চরমতম অবস্থা। বলা যায় বর্ণনাহীন চূড়ান্ত এক অর্থহীন পরিযাত্রা হচ্ছে নিহিলিজম। কি প্রাণান্ত ক্লান্তিহীন এক অনর্থক এই জীবন! আল্বেয়ার কামু দ্য মিথ অব সিসিপাসে এই অর্থহীনতার চিত্র এঁকেছেন কি দরদ দিয়ে? সত্যিই এই দুর্বিপাক থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই? কামু বলছেন, বিশ শতকের এই অব্যর্থ যাত্রা আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না। ১৯৪২-এ রচনা করেছিলেন কামু দ্য স্ট্রেঞ্জার। সেখানেও তিনি বলতে চাইছেন, এই অর্থহীনতার গল্প। অস্তিত্ববাদের প্রতিটা অনুষঙ্গে বেঁচে থাকার কি দুর্দান্ত চেষ্টা! চূড়ান্তে ব্যক্তিমানুষের পরাজয়!
নিহিলিজমের একটা প্যাথলজিক্যাল নাম হচ্ছে এবসার্ডিজম বা এবসার্ডিটি। তবে অনেকের মতে এটা ভীষণ পরিমাণ এনার্কিজমকে উস্কে দেয়। উনিশ ও বিশ শতকের জীবন-ভাবনায় যে রিলেটিভিজম যুক্ত হয়েছে তাতে ফলশ্রুতিতে নিহিলিজম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। নিহিলিজম আমাদের জীবনের গভীরতম এক সত্যের কাছে নিয়ে যায় সত্যি কিন্তু সম্ভবত এটাই শেষ কথা নয়। কারণ জীবন হচ্ছে না জানা একমুখী পথ ধরে এগোনো ক্ষণিকের এক প্রলোভন। এর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পথ সম্ভবত আর নেই। রবি ঠাকুরের কথায় শেষ না করে উপায় কী?
একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; দূর যুগান্তর হতে
মহাকালযাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তেরে তব
শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি অনন্তের পানে
সেথা তুমি একা যাত্রী, অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়॥