মোনায়েম সরকার
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর কোনো দেশ আমাদের মতো মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের লড়াই আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে। এই লড়াইয়েরই চূড়ান্ত ফসল আমাদের বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনের সোনালি ফসল। বাংলার কবি অতুল প্রসাদ সেন বলেছিলেন- ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’। বাংলা ভাষা যে বাঙালির গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে, তার প্রমাণ ইতিপূর্বে আমরা বহুবার পেয়েছি। সম্প্রতিও পেলাম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কতৃর্ক স্বীকৃতির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা ভাষার গৌরবকে আরো মর্যাদাপূর্ণ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের করেছে সম্মানিত।
মুঘল আমলে ফারসি যখন রাজভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা ভাষা তার নিজস্ব ভূখণ্ডেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এবং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এই ভূখণ্ডেরই একদল লোক ফারসি ভাষা চর্চা করতে উঠেপড়ে লাগে। আরেকটি দল থেকে যায় দরিদ্র বাংলা ভাষার কাছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ফারসি ভাষা বাংলা ভাষার ওপর চাবুক মারতে থাকে, ফারসি ভাষা বাংলাকে গ্রাস করতে চায়; কিন্তু পারে না। মরতে মরতে বেঁচে যায় বাংলা ভাষা। মুঘলদের পরে ইংরেজরা এলে বাংলা ভাষার ওপর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। তখনো বাংলা ভাষার বন্ধনকে উপেক্ষা করে, ভুলে গিয়ে বাংলা ভাষার মহিমা একদল সুবিধাভোগী ইংরেজি ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে।
তারা হয়ে ওঠে কালো সাহেব। তাদের ভাবখানা এমন যেন বাংলা তাদের বৈমাত্রেয় বোন। তারা এড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা ভাষার সংস্পর্শ। বাংলাকে তারা শুধু অনাদর আর অবহেলা করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা বাংলাকে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অব ফিশারম্যান’ বলতে শুরু করেন। এদের মধ্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) ছিলেন। কিন্তু যখন তার মোহভঙ্গ হয় তখন তিনি ঠিকই এসে মুখ লুকান বাংলা ভাষার আঁচলতলে। বঙ্কিমচন্দ্রও প্রথম প্রথম ইংরেজি ভাষা চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনিও অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলার কুঁড়ে ঘরে।
বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষা বলেই আজ স্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দিয়েই বাংলা ভাষার বয়স যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখব যে যুগে চর্যাপদ রচিত হয়েছে সে যুগে অভিজাত কেউ বাংলা ভাষার চর্চা করেননি। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পলাতক মানুষ। তারা স্থির হয়ে কেউই বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ পাননি।
যদি পেতেনই তাহলে শুধু একখানা গ্রন্থ রচনা করেই তারা ক্ষান্ত হতেন না, তাদের হাত দিয়ে আমরা আরো অসংখ্য গ্রন্থ পেতাম। তাছাড়া চর্যাপদ আবিষ্কারের মধ্যেও আছে চমৎকার বিস্ময। বাংলা ভাষার গ্রন্থ বাংলা ভূখণ্ডে পাওয়া গেল না, এটা পাওয়া গেল নেপালে। কেন বাংলা ভাষার গ্রন্থ নেপালে আবিষ্কৃত হলো- এ সম্পর্কেও নতুন করে গবেষণা হওয়া দরকার।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নুরনামা’ গ্রন্থে বলেছিলেন :
‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।’
কেন আবদুল হাকিম এ কথা বলেছিলেন তা আজ অনেকেরই জানা। কেননা তখনো একদল বাংলা ভাষাবিদ্বেষী মানুষ ছিলেন যারা বাংলা ভাষাকে মোটেই সুনজরে দেখতেন না। বাংলা ভূখণ্ডে একশ্রেণির মানুষ বাস করে- যারা এ দেশের খায়, এ দেশের পরে কিন্তু স্বপ্ন দেখে ইরান, তুরান, ইউরোপের, পাকিস্তানের। এরা পরগাছার মতো। এদের ভাষাপ্রেম তো নেই-ই, দেশপ্রেমও নেই। দেশপ্রেম আর ভাষাপ্রেম পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার দেশপ্রেম থাকে তার ভাষাপ্রেমও থাকে। যার দেশপ্রেম থাকে না, তার ভাষাপ্রেমও লোপ পায়।
যুগে যুগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে কত রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে তার দু-একটি নমুনা তুলে ধরতে চাই। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ‘রওশন হেদায়েত’ নামে একটি পত্রিকা তার ‘লেখক-লেখিকাগণের প্রতি’ নিবেদন করে বলে : “হিন্দুয়ানী বাঙালি না হইয়া দোভাষী অর্থাৎ বাঙ্গালা ভাষার মধ্যে আরবি, ফারসি ও উদুর্ ভাষা প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অ-ইসলামিক শব্দ যেরূপ স্বর্গ, নরক, যুগ, ত্রিভুবন, ঈশ্বর, ভগবান, নিরঞ্জন, বিধাতা ইত্যাদি প্রবন্ধে থাকিলে, সে প্রবন্ধ বাহির হইবে না।
লেখকগণের খেয়াল করা দরকার, বোজর্গানে দীনে যখন এদেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন তখন তাঁহারা এদেশের ভাষার মধ্যে ইসলামিক ভাষা প্রবেশ করাইয়া সর্বসাধারণকে ইসলাম শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘রওশন হেদায়েতে’রও প্রধান উদ্দেশ্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া; কাজেই কালামে কুফর প্রকাশ হওয়া উচিত নয়।”
অর্থাৎ যারা মনে করে আরবি, ফারসি, উর্দু ছাড়া অন্য ভাষা গ্রহণ করলেই বাংলা ভাষার চরিত্র নষ্ট হয় তারা প্রকারান্তরে বাংলা ভাষার শত্রুই। পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ভাষা ছাড়া সব ভাষার মধ্যই প্রচুর বিদেশি শব্দ আছে। বাংলা ভাষার মধ্যেও প্রচুর বিদেশি শব্দ ঢুকে পড়েছে কিংবা বলা যায়- নিজের প্রয়োজনেই বাংলা ভাষা বিদেশি শব্দ গ্রহণ করেছে। এটা দোষের কিছু না। এতে বরং ভাষা সমৃদ্ধ হয়। ধর্ম বিচার করে যারা শব্দ বিচার করে তাদের উদ্দেশ্যে বলতেই হয়- আল্লাহ, খোদা, নামাজ, রোজা, এবাদত, রাসুল, আদম- এগুলো বাংলা শব্দ নয় এবং আমাদের ভূখণ্ডের শব্দও নয়। জেনে শুনেই আমরা এই শব্দগুলো আত্মীকৃত করেছি।
অধ্যাপক যতীন সরকার তার একটি প্রবন্ধে (বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হিন্দু-মুসলমানি কাণ্ড) বলেছেন, ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু- এই অদ্ভুত প্রশ্নটি তো উনিশ শতকেই উঠেছিল। সে সময়েই তো নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানের মাতৃভাষা যে উর্দু সে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন। তবে, নিন্মশ্রেণির যেসব মুসলমান উদুর্কে ঠিকমতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিনি ‘মুসলমানি বাংলা’র সুপারিশ করেছিলেন।
সেই মুসলমানি বাংলা হবে প্রচলিত বাংলা থেকে আলাদা, সংস্কৃতের বদলে এতে থাকবে সেইসব আরবি-ফারসি শব্দ, যেগুলো উর্দুভাষায় বহুল ব্যবহৃত। নবাব আবদুল লতিফরা হয়তো বিশ্বাস করতেন যে এ রকম মুসলমানি বাংলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ‘আতরাফ’ মুসলমানরা একসময় উর্দুর মঞ্জিলে পৌঁছে ‘আশরাফ’দের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারবে।”
নবাব আবদুল লতিফ গংয়ের মতো এরকম আরো অসংখ্য ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা একদিন বাংলা ভাষাকে ঘিরে ধরেছিল। দুর্মর বাংলা ভাষা সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ গৌরবের মর্যাদায় আসীন। এখানে অবশ্য একটি কথা না বললেই নয় যে, বাংলা ভাষাই এশিয়া মহাদেশে প্রথম ভাষা, যে ভাষার কবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার মাত্র তেরো বছরের মাথায় এই দুর্লভ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল ও রক্ত ঝরেছিল, ১৯৯৯ সালে তা মর্যাদা পায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে জানতে ও বুঝতে শিখছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা ঘটনা।
যে ভাষাকে একদিন গলা টিপে হত্যা করার চক্রান্ত হয়েছিল সেই ভাষার সম্মানার্থেই আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। তবু দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো বাংলা ভাষা সর্বস্তরে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে গড়িমসি আছে, টালবাহানা আছে। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ক্রীতদাসরা এখনো বাংলার বদলে ইংরেজি আওড়াতে বেশি সম্মানিত বোধ করে। প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদীরা এখনো স্বপ্ন দেখে- এ দেশে আবার ফিরে আসবে আরবি, ফারসি, উর্দুর মিশেল খিচুড়ি ভাষা। বাংলাবিদ্বেষী এই কুলাঙ্গাররা শুধু বাংলা ভাষারই শত্রু নয়, এরা বাংলাদেশেরও শত্রু। এদের যথাযথভাবে প্রতিহত করতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। যদিও এই দাবি কোনোভাবেই নতুন নয়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগের সরকার। এই সরকার বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশবান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। আর বাংলা ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাতে।
যদি আমরা সত্যি সত্যিই বাংলা ভাষাকে দেশের মাটিতে এবং বিদেশিদের কাছে মূল্যবান করে তুলতে চাই, তাহলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা প্রয়োজনে নিশ্চয়ই বিদেশি ভাষা শিখবো কিন্তু কোনোভাবেই মায়ের ভাষাকে অবহেলা করে নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের মায়ের ভাষা যেন হারিয়ে না যায় সে বিষয়েও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বিলুপ্ত করা সহজ, বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। বাঙালি জাতি কঠিন কাজটি করতে কখনো পিছপা হয় না।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।