১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

শ্যামনগরে নাম মাত্র কৈয়লা আর অবৈধ কাঠ পুড়িয়ে চলছে ইটভাটা

উৎপল মণ্ডল,শ্যামনগর
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলায় আইনের তোয়াক্কা না করে উপকূলীয় অঞ্চলে অধিকাংশ ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।উপজেলার জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই গড়ে উঠা ‌এ সকল অবৈধ ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ক্লাস করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছে, ক্লাসের সময় ইটভাটার কালো ধোঁয়া সরাসরি তাদের নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। চোখে বালু ও ধোঁয়া ঢুকে যায়। ফলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।চোখেও সমস্যা হয়।ইটভাটার ট্রাক ও ভেকুসহ বিভিন্ন মেশিনের শব্দে ক্লাসের সময় তারা শিক্ষকদের কথা শুনতে পারে না। বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলা করার সময় ভাটার ট্রাকগুলো দ্রুতগতিতে আসে।এতে তারা ভয় পায়।এ প্রসঙ্গে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা.মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়,তাহলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্টসহ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়।এতে বৃদ্ধ এবং শিশুদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।ফলে এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। সাতক্ষীরা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শ্যামনগর উপজেলায় রয়েছে ১৪টি ইটভাটা। এর মধ্যে ঝিকঝাক এবং সনাতনী পদ্ধতির ভাটাও রয়েছে। এসব ভাটার মধ্যে অধিকাংশেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। পরিবেশের ছাড়পত্র বিহীন এসব অবৈধ ইটভাটার কোনো সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্সও নেই। শুধুমাত্র উচ্চ আদালতে একটি রিটের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাটা।উচ্চ আদালতে রিট করার কারণে এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর।এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি না থাকায় অবৈধ এসব ভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ,সোয়াবিনের গাঁথ,তুষকাঠ ও টায়ার পোড়ানো বিষাক্ত কালি। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়,সম্প্রতি উচ্চ আদালত এক আদেশে দেশের সব অবৈধ ইটভাট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।তারপরও অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এসব অবৈধ ইটভাটা পুরোদমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে সেখানে অধিকাংশ ভাটায় কয়লার সাথে তুষকাঠ মিশিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।সাথে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ,সোয়াবিনের গাঁথ ও টায়ার পোড়ানো বিষাক্ত কালি। রামজীবনপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে ইটভাটার পাশেই স্তূপ আকারে ফেলা রয়েছে জ্বালানি কাঠ।পাশের আরও একটি ঘরে রয়েছে তুষকাঠ।
উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের হাটছালা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জনবসতিপূর্ণ ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে উঠেছে গাজী ব্রিকস নামক একটি ইটভাটা।ভাটার প্রবেশমুখে হাইকোর্টের একটি রিট পিটিশনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তোয়াক্কা না করে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ এবং চারপাশে স্তূপ আকারে সাজানো রয়েছে জ্বালানি কাঠ।এছাড়াও খানপুর এলাকার সাকিব ব্রিকসে গিয়ে দেখা যায় ভাটায় প্রবেশমুখে একটি বড় ঘরে সাজানো রয়েছে তুষকাঠ।এভাবে জনবসতি এলাকায় অবস্থিত ভাটায় জ্বালানি হিসেবে পুরোদমে কাঠ ও তুষকাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে।এসব ভাটার কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণ করে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে স্থানীয় এলাকাবাসীর। একইভাবে তুষকাঠ ও টায়ার পোড়ানো বিষাক্ত কালি ব্যবহার করা হচ্ছে উপজেলা সদরের সোনার মোড় এলাকায় এইচবি ব্রিকস ও আশা ব্রিকস, খানপুরে গাজী ব্রিকসসহ অধিকাংশ ইটভাটায়। ইটভাটায় কর্মরত কয়েকজন শ্রমিক জানান,সংশ্লিষ্ট ভাটামালিকের নির্দেশে দিনে অল্প কয়লা ও সারারাত শুধু জ্বালানি কাঠ,সোয়াবিনের গাঁথ,তুষকাঠ ও টায়ার পোড়ানো বিষাক্ত কালি ব্যবহার করে করে তাঁরা ইট পোড়াচ্ছেন। ইটভাটায় জ্বালানির কাজে কয়লার বদলে কাঠের ব্যবহার প্রসঙ্গে গাজী ব্রিকস এর ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম লিটন জানান,প্রথমে কাটায় নতুন আগুন জ্বালানোর সময় ভাটার ভিতরে অল্প কিছু কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।কয়লার দাম বেশি হওয়ায় সাথে তুষকাঠ ব্যবহার করা হয়।উপজেলা রামজীবনপুর এলাকার একটি ইটভাটার ম্যানেজার জানান,যশোরের নওয়াপাড়ার ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে কয়লায় পানি মিশিয়ে ওজন বৃদ্ধি করে।এছাড়া দামও অনেক বেশি হাওয়ায় বাধ্য হয়ে কাঠ পোড়াতে হচ্ছে।তাছাড়া কয়লা দিয়ে পোড়ালে ইটের দামও বেড়ে যায়।সেজন্য কাঠ দিয়েই ইট পোড়ানো হচ্ছে।গত বছর আমাদের ভাটায় অনেক টাকা লোকসান হয়েছে।ফলে এই মুহূর্তে শুধুমাত্র কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো একেবারেই অসম্ভব।তাই আমরা জ্বালানি হিসেবে কয়লার সাথে তুষকাঠ ব্যবহার করছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার এক ইটভাটার শ্রমিক বলেন,ভাটায় কাঠ ব্যবহার করলে প্রতিটি ইটে খরচ ১-২ টাকা কম হয়। এজন্য অধিক লাভের আশায় ভাটা মালিকরা কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করে।হাটছালা গ্রামের কৃষক মনোতোষ মন্ডল (৬০) বলেন, অবাধে কাঠ পোড়ানোয় একদিকে যেমন উজাড় হচ্ছে বন অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে তৈরি করা হচ্ছে ইট।এতে কমছে জমির উর্বরাশক্তি। প্রতিদিন শত শত ট্রাক মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে।ফসলি জমির উপরের অংশ কেটে ফেলে মাটি ভাটায় আনা হচ্ছে।এ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ধোঁয়া ও বালুকণার কারণে গাছপালা ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।অন্যদিকে সোনার মোড় এলাকার শোকর আলী নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের ৩০ বছরের বসতভিটা।আগে একটি ভাটা ছিল।এখন চারপাশে চারটি ইটভাটা।ধুলাবালি আর ধোয়ায় ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।ঘরের ভেতর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বাস করছি।ইটভাটার ধোঁয়া ও বালুকণার কারণে বাড়িতে কোন গাছ-গাছালি বা খেতে ফসল ফলানো যাচ্ছে না। শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, উপজেলায় অধিকাংশই ইটভাটাগুলো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কৃষিজমিতে স্থাপন করা হয়েছে।তারপরও আবার ভাটায় কাঠ পোড়ানোর কারণে ফসলের ফলন বিপর্যয় ঘটছে। ইটভাটার কারণে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে।এছাড়াও ইটভাটায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।এ কারণে ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে।বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতর সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম।তিনি বলেন,অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।শ্যামনগর উপজেলায় ১৪ টি ইটভাটার মধ্যে অধিকাংশই অবৈধ উল্লেখ করেই তিনি আরো বলেন, এসব ভাটা মালিকরা উচ্চ আদালতে রিট করে তাদের ভাটা পরিচালনা করছেন।যে কারণে রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না।ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ভাটার রিট নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সর্ম্পকে তিনি বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত জবাব পাঠাব।সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহম্মদ হুমায়ুন কবির জানান,অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।লাইসেন্স ও পরিবেশের কাগজপত্র না থাকায় ইতোমধ্যে বেশকিছু ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানাসহ ভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সাতক্ষীরার সব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। ওই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা যাবে না।একই আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স না নিয়ে কোনো ইটভাটায় ইট তৈরি করা যাবে না। যদিও এসব ধারা লঙ্ঘন করে চলেছে উপজেলার প্রায় সকল ইটভাটা।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়