আমিনুল ইসলাম
আমি আমার আরও দু’একটি লেখায় বলেছি, শিল্প-সাহিত্যের সৃজনশীল অঙ্গনে বাঙালি অনেক বেশি এগিয়ে কিন্তু একই ভুবনে মননশীলতার অঙ্গনে তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক পিছিয়ে। আমি পণ্ডিত নই কিন্তু সমাজমনস্ক ও ইতিহাস সচেতন। শিল্প-সাহিত্যের ভুবনটাই আমার অন্তরঙ্গ বিচরণের ভূগোল। সেই বিচরণজনিত অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান বলে বাঙালি অনেক বেশি আবেগপ্রবণ এবং তার বসবাসের ভূগোলও উর্বরতায় অগ্রগামী। সে মোকাবিলা করে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের। এটা তাকে বিপ্লবী হতে উৎসাহ ও উত্তেজনা দিয়েছে চিরদিন। বুদ্ধিবৃত্তির উঠোনে তার বিপ্লবী ও প্রতিবাদী মানসিকতার সঙ্গী হয়েছে কবিতা, গান, যাত্রাপালা, নাটক, আর্ট ইত্যাদি। সে অভ্যস্ত ও সুদক্ষ হয়েছে এসব রচনায় ও উপস্থাপনায়। কিন্তু সে তুলনায় সে পায়নি বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ ও সময়, সে তুলনায় সে পায়নি মূল্যায়ন, আত্মমূল্যায়ন, নিরীক্ষা ইত্যাদির প্রয়োজন ও প্রেরণা, সময় ও সংযম। ফলে তার হাত দিয়ে সমৃদ্ধ মননশীল সাহিত্য গড়ে ওঠেনি।
আমরা অবশ্যই দু’চারজন বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দকে পেয়েছি কিন্তু সেটা তো প্রয়োজনের অনুপাতে অনেক কম। আশার কথা এই, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ লেখকদের অনেকেই সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি মননশীল সাহিত্য রচনায় এগিয়ে এসেছেন। তারা সংখ্যার দিক থেকেও নেহায়েত কম নন। তারা নিজেদের সৃষ্টির মূল্যায়ন করছেন, তেমনিভাবে অগ্রজদের সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন করছেন নতুন ধাঁচে ও মনে। আবু আফজাল সালেহ তেমনই একজন তরুণ সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক। তিনি কবিতা লেখেন, রাষ্ট্র-সমাজ-বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেন এবং অগ্রজ ও সমসমায়িক কবি-কথাসাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ-পর্যালোচনা গদ্য লেখেন। জাতীয় দৈনিকসমূহের সাহিত্যপাতায় তার উপস্থিতি নিয়মিত ও উজ্জ্বল। একইসঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েবজিন, অনলাইন পত্রিকাতেও তাকে নিয়মিত পাঠ করা যায়। আমি নিজেও তার অনেকগুলো মননশীল লেখা পাঠ করেছি প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায়। আজ আমার বাড়তি ভালো লাগা এই, আবু আফজাল সালেহের বাছাই করা কিছু মননশীল রচনা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কাব্যশৈলীর কতিপয় দিগন্ত’। নামকরণটি চমৎকার। ‘কাব্যশৈলীর কতিপয় দিগন্ত’ গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে অনেক কয়টি প্রবন্ধ।
প্রবন্ধগুলোর অধিকাংশ আমি আগেই পড়েছিলাম। আবার পড়লাম নতুন করে। প্রবন্ধগুলোর বিষয় পুরোনো এবং এসব বিষয়ে ইতোপূর্বে আরও অনেকেই অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন যেসব এখনো এখানে ওখানে সহজলভ্য। সেসব প্রবন্ধের উপস্থাপিত ও বিশ্লেষিত বিষয়াদি ও প্রদত্ত অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও আবু আফজাল সালেহ প্রায় একই বিষয়সমূহ নিয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখতে প্রেরণা ও প্ররোচনা বোধ করেছেন। কারণটা সম্ভবত এই যে—কবিতার শৈল্পিক দিকসমূহ নিয়ে সহজ ভাষায় সমৃদ্ধ রচনার অভাব আজও কিছুটা রয়েই গেছে। কবিতা কী, কবিতায় ছন্দের আবশ্যকতা কোথায়, কীভাবে ছন্দ নির্ণয় করা হয়, কাকে বলে চিত্রকল্প অথবা দ্যোতনা ইত্যকার বিষয় টেকনিক্যাল প্রকৃতির। এসময়ে কবিতা লিখতে আসা তরুণদের একটা বড় অংশই কবিতার শৈলী বিষয়ক ওইসব গ্রন্থ পাঠে আগ্রহী নয় বললেই চলে। তাদের অনেকেই কবিতায় ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প, দ্যোতনা ও অন্যান্য কাব্যালংকারের আবশ্যকতা বিষয়ে প্রকাশ্যেই কঠিনভাবে অযৌক্তিক দ্বিমত পোষণ করেন, যা প্রকৃত কবিতাচর্চার অনুকূল নয়।
সালেহ তার প্রবন্ধসমূহে কবিতার শৈলীগত দিকসমূহ ও সেসবের অপিরহার্যতার প্রসঙ্গসমূহ পর্যাপ্ত উদাহরণ সহকারে উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি একাজে পূর্বজনদের লেখা থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে তার সাথে নিজস্ব ব্যবহারিক জ্ঞান, বিবেচনা ও বিচার যুক্ত করেছেন। এধরনের কমন বিষয় নিয়ে নতুন করে লেখা কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটি সালেহ অনেকটা সহজভাবেই করেছেন। ‘কবিতার শিল্পগুণ: কবি ও পাঠকের দায়’, ‘শিল্প-সাহিত্যে নন্দনতত্ত্ব, কবিতায় নন্দনতত্ত্ব’, ‘দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা গুণ: কবিতার শব্দরা অজেয়’—তিনটি প্রবন্ধ অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুলিখিত। কবিতা লেখার সময় প্রবন্ধগুলো পাঠ থেকে অর্জিত জ্ঞান ও নির্দেশনা মনে ও সক্রিয় বিবেচনায় রাখলে কবিযশপ্রার্থীরা কোনো না কোনোভাবে সচেতনে অথবা অবচেতনে উপকৃত হবেন বলে আমার জোরালো ধারণা। ‘কবিতা কী’ শীর্ষক প্রবন্ধে সালেহ বলেছেন, ‘আমি বলি কি, কবিতা আটপৌরে শাড়িপরা প্রেমিকার মতো। তাকে সাজাও। পরিমিত বোধে সাজালে অনিন্দ্য হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য বিকরিত হয়, বিচ্ছুরিত হয়, সুগন্ধ বের হয়। পাঠক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। একইসঙ্গে স্রষ্টার এক বা একাধিক সুন্দর বার্তাও পেয়ে যান। যে-বার্তা পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক বদল করে দিতে পারে। সমৃদ্ধ হতে পারে আচার-আচরণে।’
তিনি খুব সহজভাবে ও সাবলীল ভঙিমায় তার পরিষ্কার অভিমত প্রদান করেছেন। তার এই অভিমত সহজবোধ্য অথচ শাণিত ও সুগভীর। সালেহর এই একটিমাত্র অভিমতের মানদণ্ডেও একটি কবিতা সংকলন হাতে নিয়ে সেখান থেকে কবিতা এবং অকবিতা, উৎকৃষ্ট কবিতা এবং উনকবিতা বাছাই করে নেওয়া সম্ভব। এসব বিষয় অস্বীকার করে যাচ্ছেতাই মন নিয়ে উৎকৃষ্ট মানের কবিতা রচনার কোনো পথ নেই। অথচ আজকাল রচিত কবিতা নামের একটা বড় অংশই সুগন্ধহীন, সৌন্দর্যশূন্য এবং উপভোগ্যতার অভাবে রিক্ত। রঙিন আকাশ মিডিয়া আর ইন্টারনেট-ফেসবুকের সহজলভ্যতায় আজকের নিত্যব্যস্ত অর্থনৈতিক সময়ে পাঠক পকেটের টাকা, সময়, মেধা ও মন ব্যয় করে এসব রিক্তকথার নীরস পাঠ নেবেন কোন দায়ে পড়ে? সালেহের প্রবন্ধ আমাদের মতো কবিতাকর্মীদের সঠিক পথটিকে নতুন করে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে। যারা কবিতা রচনায় চেষ্টারত, তারা সবাই কমবেশি সেই পথের কথা জানেন কিন্তু প্রচারিত ও প্রশংসিত ভ্রান্তি দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে অনেকেই ভুলপথের পথিক হন।
গ্রন্থটিতে আরেক ধরনের প্রবন্ধ আছে। জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমান এবং জসীমউদ্দীন ও আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতার তুলনামূলক আলোচনা। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রত্যেক কবিই তার পূর্বজ এবং সমসাময়িক অন্যান্য কবির সঙ্গে যুক্ত আবার তাদের মধ্যে কিছু মিলের সাথে প্রচুর পার্থক্যও আছে। অথচ তারা সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত। এসব আলোচনা আজকের এবং আগামীকালের কবিদের দেখিয়ে দিতে সমর্থ আলোচিত কবিগণের প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতির প্রকৃত কারণসমূহ। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে যেমন পূর্বজ কবিদের কবিতার কথা মনে রাখতে হয়, তেমনই ভেবে দেখতে হয় কীভাবে নতুন পথ করে নিতে হয় প্রতিষ্ঠিত প্রচুর পথের মাঝে থেকেই। পূর্বজনদের সৃষ্টিকর্ম অধ্যয়ন করত সেখান থেকে আলো নিতে হয় এবং নিজের অন্তরের ও মেধার আলোর সঙ্গে সেই আলো যোগ করে তাকে কাজে লাগিয়ে খুঁজে নিতে হয় আপন অঙ্গন ও পথ।
সালেহের সুচিন্তিত ও সুলিখিত তুলনামূলক আলোচনাভিত্তিক প্রবন্ধগুলো পাঠে কবিযশপ্রার্থীরা আলো পাবেন, দিকনির্দেশনা পাবেন এবং প্রেরণা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু একথা ঠিক যে, কবিতার ব্যাকরণের বই পড়ে কেউ কবি হতে পারে না যদি না তার জন্মগত নিজস্ব কাব্যমেধা থাকে। বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বলেছেন: ‘Acting School helps to know ‘What is Acting?’, but there’s no School or University to make you Mr. Shah Rukh Khan.’ কবি হওয়ার ক্ষেত্রেও একইকথা প্রযোজ্য। তবে কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ কাব্যমেধাহীন মানুষকে কবি বানাতে পারে না সত্য কিন্তু কাব্যমেধাসম্পন্ন ব্যক্তিকে তার সৃজনশীলতায় একধরনের পরোক্ষ সহায়তা জোগাতে পারে। গ্রন্থভুক্ত ‘কবিতার অমরত্ব: ডু সামথিং ডিফ্রেন্ট’ একটি নিবিড়ভাবে সুচিন্তিত ও সুলিখিত প্রবন্ধ। যে কোনো প্রধান ভাষায় কবিতা লেখেন শতশত মানুষ কিন্তু কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন অল্প কয়েকজন। আসলে একজন কবির টিকে যাওয়া ও টিকে থাকার আসল শক্তিটি হচ্ছে তার নিজস্বতা উদাহরণ সহযোগে খুব যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রবন্ধের বিষয়টি।
‘কাব্যশৈলীর কতিপয় দিগন্ত’ পাঠে আমি কি ষোলোআনাই তৃপ্ত? আর কোনো প্রত্যাশা ছিল না আমার—আবু আফজাল সালেহের কাছে? না, আমার কিছু অতৃপ্তিও আছে। তিনি কবিতার ছন্দ, চিত্রকল্প, দ্যোতনা, রস, শব্দ ও উপমার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাকালে বহু কবির কবিতা থেকে উদাহরণ দিয়েছেন এবং আলোচনার দিকগুলোকে প্রামাণ্য চারিত্র্য প্রদান করেছেন। কিন্তু প্রায় সব উদাহরণ বা উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-সুকান্ত-বিষ্ণু দে-সুভাষ মুখোপাধ্যায়- শামসুর রাহমান-শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ অতি অগ্রজ কবিদের কবিতা থেকে। তিনি যদি এসব ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের কবিদের কবিতা থেকেও কিছু উদ্ধৃতি দিতেন, তাহলে বিষয়গুলো বর্তমান প্রজন্মের কবি ও কবিতাপাঠকদের মনে বাড়তি ভালো লাগা ও প্রেরণার সৃষ্টি করতো। তারা দেখতে পেতেন এবং বিশ্বাস করতে বাধ্য হতেন যে ছন্দ, চিত্রকল্প, ব্যঞ্জনা, রস ইত্যাদি কেবল অতীতের কবিদের চর্চার বিষয় ছিল না, এসব এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয়, অনুসৃত ও অনুসরণযোগ্য।
যদি খুব সংক্ষেপে বলতে হয়, আমি বলবো, আবু আফজাল সালেহের প্রবন্ধগুলো তার ব্যাপক পঠনপাঠন, চিন্তা ও নিজস্বতার সমবায়ী ফসল। প্রবন্ধগুলো নাতিদীর্ঘ, সহজবোধ্য ও সাবলীল। তিনি কবি বলে প্রবন্ধগুলোতে পাণ্ডিত্বের কচকচানির চেয়ে সুবোধ্যতার সচ্ছলতা বেশি। তার উপস্থাপনার মধ্যে কোথাও কোথাও কিছু ছোটখাটো ঘাটতি আছে কিন্তু কোনো সক্রিয় পক্ষপাত কিংবা সচেতন বৈরিতা নেই। অতিশয়োক্তি চোখে পড়েনি বললেই চলে। নামকরণের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই প্রবন্ধ নির্বাচন করা হয়েছে এবং তা যথার্থ হয়েছে। হয়তো আনুষঙ্গিক আরও দুএকটি প্রবন্ধ যোগ করা গেলে আরও ভালো হতো কিন্তু ভালোরও তো কোনো শেষ নেই।
আমি জেনেছি, আবু আফজাল সালেহ একটি কর্মমুখর ব্যস্ততার চাকরি করেন। তিনি কবিতা লেখেন। বাংলাদেশে মননশীল সাহিত্য রচনার পরিবেশ উৎসাহব্যঞ্জক তো নয়ই, এতটুকুও অনুকূল নয়। এখানে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার কিংবা নির্মোহ ও নিরপেক্ষ অভিমত প্রদানের পথটি প্রতিকূলতায় আকীর্ণ। অধিকন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রন্থের বাজার ভাটার কবলে, বলা যায় প্রায় লোকসানমুখী। এমন অবস্থায় মননশীল প্রবন্ধ রচনা এবং সেসব নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রবাদটিকে তুলনায় নিয়ে আসে। কিন্তু বনের মোষ তাড়ানোর মানুষ তো জুটেই যায়। মোষ যে তাড়ায় সে বাহবা লাভ করুক বা না করুক, অন্যদের তো উপকার হয়। এ ক্ষেত্রে সেই অন্যেরা হচ্ছেন এসময়ের কবিতাকর্মী এবং পাঠকগণ। আমি নিজেও সেই দলে পড়ি। তাদের সবার পক্ষ থেকে এবং আমার নিজের পক্ষ থেকেও আবু আফজাল সালেহকে অভিনন্দন জানাতে চাই, ধন্যবাদও।
লেখক: কবি ও নজরুল গবেষক, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব।