মাহমুদ আহমদ
মহান আল্লাহর অপার কৃপায় পবিত্র শাবান মাস আমরা অতিবাহিত করছি। আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি, পবিত্র শাবান মাসের ৫ তারিখ। ইসলাম ধর্মে চন্দ্রমাসের মধ্যে শাবান মাস বিশেষ বরকতপূর্ণ। কেননা অন্য মাসের তুলনায় এ মাসের বিশেষ কিছু নফল আমল রয়েছে, যা আমল করলে আমরা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি এবং জান্নাত লাভের পথ সুগম হবে। এছাড়া মোমেন মুত্তাকিরা বরকতপূর্ণ শাবান মাস থেকেই পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতি নেন। তারা শাবান মাসেই একটি রুটিন তৈরি করে নেয় যে, আগের রমজান থেকে আগত রমজানে কি কি নেক আমল বেশি করবে।
হাদিস পাঠে জানা যায়, শাবান মাস আসার আগেই মহানবি (সা.) দুই হাত তুলে এ দোয়া পাঠ করতেন এবং সাহাবাদেরও পড়তে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবাও ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা ইলা শাহরির রমাদান’ (মসনদে আহমদ)। অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।
তাই এ মাসকে বলা হয় মাহে রমজানের আগমনী বার্তা। শাবান মাস মূলত পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস। মহানবি (সা.) শাবান মাসে অন্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও নামাজ আদায় করে মাহে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। উম্মুল মোমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘নবি করিম (সা.) কখনো নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি বিরতি দেবেন না।
আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে, তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি মহানবিকে (সা.) রমজান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি নফল রোজা রেখেছেন’ (মুসলিম)। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে মহানবি (সা.) এত অধিক হারে নফল রোজা আদায় করতেন না’ (বোখারি)।
স্রষ্টার পরে মাখলুকের মধ্যে বিশ্বনবি (সা.) স্থান প্রথম হওয়ার পরেও তিনি রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে আগ থেকেই রোজা রাখা শুরু করতেন। নবি করিম (সা.) এ মাসে অধিকহারে নফল ইবাদত-বন্দেগিও করতেন। এ সম্পর্কে হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, মহানবিকে (সা.) জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার কাছে মাহে রমজানের পর কোন মাসের রোজা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘রমজান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোজা উত্তম’ (তিরমিজি)।
মাহে রমজানে দীর্ঘ ৩০টি রোজা পালনের কঠিন কর্মসাধনা সহজভাবে আদায় করার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শাবান মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা আমরা যদি রমজান শুরু হওয়ার আগেই শাবান মাসে কয়েকটি নফল রোজা রেখে নেই তাহলে রমজানের রোজা রাখতে আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘ মহানবির (সা.) প্রিয় মাসের একটি হলো শাবান। এ মাসে নফল রোজা আদায় করেই তিনি মাহে রমজানের রোজা পালন করতেন’ (আবু দাউদ)।
রমজানের বরকত সম্পর্কে হাদিসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে এবং নিজের গুনা ক্ষমার জন্য আদায় করে তাহলে তাকে বিগত বছরের পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে আর যদি তোমরা জানতে যে, রমজানের কী কী ফজিলত রয়েছে তাহলে তোমরা অবশ্যই এ বিষয়ে ইচ্ছা পোষণ করতে যে, সাড়া বছরই যেন রোজা হয়’ (আল জামেউল সাহি মুসনাদ, কিতাবুল সওম)।
তাই আমাদের এখনই রমজানের কল্যাণ থেকে কল্যাণ মণ্ডিত হওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। শুধু রোজা রাখলেই কি রমজান মাসের সার্থকতা? অবশ্যই না। রমজানে রোজাও রাখতে হবে এবং অধিকহারে নফল ইবাদত, দান খয়রাত এবং পুণ্যকর্মও করতে হবে।
পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন ‘রমজান সেই মাস যাতে নাজেল করা হয়েছে কোরআন যা মানবজাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েত ও ফুরকান অর্থাৎ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয়ক সুস্পষ্ট প্রমাণাদি। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এই মাসকে পায়, সে যেন এতে রোজা রাখে, কিন্তু যে কেউ রুগণ এবং সফরে থাকে তাহলে অন্য দিন গণনা পূর্ণ করতে হবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান এবং তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না এবং যেন তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তন কর, এজন্য যে, তিনি তোমাদের হেদায়াত দিয়েছেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৪)।
এ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান আমাদের জন্য কাঠিন্য চান না। আল্লাহ জানেন রমজান আমাদের জন্য কোনো কষ্টের কারণ নয় বরং আনন্দের। কিন্তু আমরা যারা দুর্বল তারা মনে করি রমজান মাস কষ্টের মাস। আসলে এটা যারা ভাবেন তারা অনেক বড় ভুল করেন। আল্লাহ আমাদের জন্য কাঠিন্য চান না।
এছাড়া মহানবি (সা.) রমজানের আগে শাবান মাসে অনেক বেশি ইবাদত করতেন আর তিনি (সা.) রমজান ছাড়া প্রতি মাসে নফল রোজা রাখতেন। তাই আমরাও যদি মহানবির (সা.) সুন্নত অনুযায়ী রমজানের আগে কয়েকটি নফল রোজা রেখে নেই তাহলে পবিত্র রমজানের দিনগুলোতে রোজা রাখতে তেমন কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তাই আমরাও যদি শাবান মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে নফল ইবাদতে অতিবাহিত করি আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করতে শুরু করি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সুস্থ রাখ, আমি যেন আগত রমজানে আগের তুলনায় অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি, দানখয়রাত, কোরআন পাঠসহ সব পুণ্যকর্ম বেশি বেশি করতে পারি। একই সাথে আমাদের এ দোয়াও করা উচিত, আল্লাহতায়ালা যেন মুসলিম উম্মাহকে সুন্দরভাবে রমজানের দিনগুলো অতিবাহিত করার তৌফিক দান করেন, আমিন।
লেখক: প্রবান্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।