১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

শুঁটকির জন্য জমজমাট জামালপুরের রানীগঞ্জ হাট

প্রতিদিনের ডেস্ক
শত বছর আগে জামালপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠে রানীগঞ্জ বাজার। একসময় পাট, সরিষা, ধান, বাঁশ, বেতের তৈরি পণ্য, মাছসহ অন্য পণ্যের রমরমা ব্যবসা থাকলেও ধীরে ধীরে তার জৌলুস হারায়। বর্তমানে শুঁটকি মাছের হাট ঘিরে আবারও আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩৫ লাখ টাকার শুঁটকি বেচাকেনা হয় এই হাটে।
স্থানীয়রা জানান, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বংশ খাল দিয়ে প্রায় ৩০০ বছর আগে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও সওদাগররা তাদের বিশাল বিশাল বজরা নৌকায় উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে যাতায়াত করতেন। যাওয়া-আসার সময় বিশ্রামের জন্য তারা এখানে বিশ্রামাগার তৈরি করেন। কালক্রমে একটি গঞ্জ গড়ে ওঠে এখানে। এলাকাটি একসময় ‘গঞ্জের হাট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে এখানকার ব্যবসায়িক সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৩ সালে ১০ একর জায়গার ওপর একটি বাজার তৈরি করা হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, ভিনদেশের বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য হাটের কাছাকাছি একটি যৌনপল্লি ও পানশালা তৈরি করা হয়। বিদেশি বণিকরা এখানে থাকা নারীদের ‘রানী’ বলে সম্বোধন করতেন। একসময় এটি ‘রানীর হাট’ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং কালক্রমে এটির নামকরণ করা হয় ‘রানীগঞ্জ হাট’।
বাজার কমিটি সূত্র জানায়, জামালপুর ছাড়াও ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগম হতো এই হাটে। জলপথে পণ্য আনা নেওয়া সহজ হওয়ায় হাটের ঘাটে ভিড়তো শত শত মণ বোঝায় ধান, পাট, চাল, গমসহ বিভিন্ন শস্য ও সবজিবাহী নৌকার বহর। সকাল থেকে রাত অবধি চলত বিকিকিনি।
এই হাটে আসতো মুন্সিগঞ্জের আলু, পাবনার পেঁয়াজ-রসুন, সিরাজগঞ্জের গুড়, শাড়ি, কাপড় ও লুঙ্গি এবং রংপুর ও দিনাজপুরের তামাক পাতা। হাট থেকে ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে যেতো পাট, ধান, মরিচ, বেগুন, সরিষা ও নানা রবিশস্য। গুণগতমানের দিক থেকে জামালপুরের পাট ছিল দ্বিতীয় স্থানে। সেই পাট বেচাকেনা হতো এই হাটে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিনদিন এর জৌলুশ হারাতে থাকে। তবে দিনদিন জনপ্রিয় হতে থাকে শুঁটকির হাট। বর্তমানে এটি ‘রানীগঞ্জ হাট’ এর চেয়ে ‘শুঁটকির হাট’ নামেই বেশি পরিচিত।
রানীগঞ্জ হাটে ৩৫টি শুঁটকির আড়ত রয়েছে। আড়তগুলোকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের। প্রতিদিন বেচাবিক্রি হলেও সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার এখানে জমজমাট শুঁটকির বাজার বসে। এইদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি ক্রেতার সমাগম হয়। এখানে প্রায় ৫০ জাতের শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়। মান ও জাতভেদে সর্বনিম্ন ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০০-২৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এসব শুঁটকি।
দীর্ঘদিন ধরে রানীগঞ্জ হাটে ব্যবসা করছেন হেলাল মিয়া। তিনি জানান, ২৫ বছর ধরে তিনি এ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হয় এই হাটে। এখানে প্রায় সব ধরনের শুঁটকি পাওয়া যায়। শুঁটকিভেদে দামও ভিন্ন। তবে রুপচাঁদা, চিংড়ি, কোরাল মাছের শুঁটকির দাম সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদিন ধরে জেলার চাহিদা মিটিয়েও আশপাশের জেলায়ও যাচ্ছে রানীগঞ্জের শুঁটকি।
মেসার্স অলিউল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও হাট কমিটির সাধারণ সম্পাদক অলিউল্লাহ বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকির বাজার চট্টগ্রাম থেকে তারা এসব শুঁটকি কিনে আনেন। পরে তারা খুচরা ও পাইকারি দরে বিক্রি করেন। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার ক্রেতার সমাগম হয় সবচেয়ে বেশি। বছরে ৯ মাস বেচাকেনা খুব ভালো থাকলেও মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত একটু মন্দা থাকে বলেও জানান তিনি।
জেলা মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, রানীগঞ্জ হাটে শুঁটকির আড়ত ঘিরে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি দেশের রাজস্ব খাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহনাজ ফেরদৌস মুঠোফোনে বলেন, ‘রানীগঞ্জ বাজারের কথা শুনেছি। এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। যদি কিছু করার থাকে তাহলে অবশ্যই সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়