প্রতিদিনের ডেস্ক
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সেখানকার ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আশপাশে আগুন ছড়িয়ে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পুরো এলাকা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৬৭ জন। ঘটনার পরদিন ওই এলাকার বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলেসহ আটজনের বিচার শুরু হয়েছে। তবে, বিচার শুরুর এক বছরেও শেষ হয়নি মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ।
মামলার বাদী বলছেন, বিচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কোনো ক্ষতিপূরণও পাননি। অপরদিকে, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ও হাসানের আইনজীবীর দাবি, সবকিছু হারিয়ে ঘটনার ভিকটিম হয়েছেন তারা।
চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় চকবাজার মডেল থানায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সুলতান সোহেল ও মোহাম্মদ হাসান সুলতানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রায় তিন বছর তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুম আট আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪, ৪২৭, ৩৩৬ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এখনো শেষ হয়নি বাদীর সাক্ষ্য, পাননি ক্ষতিপূরণ
মামলাটি বিচারের জন্য ওই বছরের ২৮ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হয়। চার মাস পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালত আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন। একই সঙ্গে আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের পর ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর মামলার বাদী আদালতের আংশিক সাক্ষ্য দেন। এখনো তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। আগামী ১৪ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
মামলার আট আসামিই জামিনে
মামলায় ভবনের মালিকের দুই ছেলে হাসান ও সোহেলসহ আট আসামিই জামিনে রয়েছেন। তারা সবাই বিচারিক আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। রাসায়নিক গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল ইকবাল, ব্যবস্থাপক মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াব আতির, মো. নাবিল ও কাশিফ উদ্দিন জামিনে রয়েছেন।
অবহেলায় ‘হত্যাকাণ্ড’
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে করা মামলায় আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলায় আসামি মোহাম্মদ হাসান সুলতান ও সুলতান সোহেল অসৎ উদ্দেশ্যে এবং অধিক লাভে বশীভূত হয়ে আসামি ইমতিয়াজকে আবাসিক বাড়িটি গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেন। অর্থাৎ ভবনের মালিক ও গোডাউন ভাড়াটিয়াদের অবহেলার কারণেই এ ঘটনা ঘটে। আসামি মোজাফফর মানুষের জানমালের ক্ষতি হতে পারে জেনেও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আসামি কাশিফ ও নাবিল গোডাউনের মালিক না হলেও সেলসম্যান হিসেবে ব্যবসা করেছেন। আসামি ইমতিয়াজ পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মূল মালিকের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন।
চুড়িহাট্টায় আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী মো. জুম্মনের ছেলে ও মামলার বাদী মো. আসিফ বলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেলো, এখনো ন্যায়বিচার পেলাম না। কবে পাবো ঠিক নেই। কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি। বছরের একটা দিনে সবাই খোঁজ নেয়। বাকি দিনগুলো কেউ খোঁজ নেয় না। মামলার বিচারকাজে অনেক ধীরগতি। প্রতি তারিখে আদালতে যাই, কিন্তু বিচারক থাকেন না, নানা অজুহাতে সাক্ষ্য হয় না।
তবে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ও হাসান সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে দাবি করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মোস্তফা পাঠান। তিনি বলেন, আমরা সবই হারিয়েছি। ঘটনার ভিক্টিমাইজ। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভবন ভাড়া দিয়েছে মালিকপক্ষ। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। আশা করছি, ন্যায়বিচার পাবো।
এখনো শেষ হয়নি বাদীর সাক্ষ্য, পাননি ক্ষতিপূরণ
ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মাজহারুল হক বলেন, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহতের ঘটনায় করা মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ২১ মার্চ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়েছে। মামলার বাদীর এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। আশা করছি, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা। চকবাজার মডেল থানার চুড়িহাট্টা শাহী জামে মসজিদের সামনে রাস্তায় একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের আরেকটি প্রাইভেটকারে আগুন লাগলে সেই গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়। ওই সময় চুড়িহাট্টার নন্দকুমার দত্ত রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে একটি পিকআপভ্যানে গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওই পিকআপের সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বাড়ির নিচতলা ও রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে।
মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেটকার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। নিমেষেই চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে ‘মৃত্যুকূপ’। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এ ঘটনায় মোট ৭১ জনের মৃত্যু হয়।