২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
একটা ঠান্ডা পোকা শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে আসছে, আমি পিছু ফিরতে পারছি না, যে কোনো মানুষই এই সময় তাদের মেরুদণ্ডের এই হিমস্পর্শের কাছে অসহায় হয়ে যায়। আমি চৌকাঠের বাইরে থেকে ভেতরটায় তাকিয়ে আছি। ঝুলন্ত রঞ্জনের পায়ের উপরটা দেখা যাচ্ছে না, শরীর থেকে নেমে আসা হলদে কিছু বা লাল কিছু একটা মৃদু রেখার মতো পায়ের থেকে টপ টপ করে মাটিতে পড়ছে। পায়ের ঠিক নিচে একটা বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। এর পরের পাঁচ দশকের এই আমার যে জীবন, এই ক্ষত ও কাঁটায়, ফুলে ও হিমের জীবন সেই ঝুলন্ত, দোদুল্যমান পা, হলদে হয়ে যাওয়া পা পেন্ডুলামের মতো ঝুলতে ঝুলতে আমকে কিছু বলছে, বলে যাচ্ছে, একটা বৃত্ত সেই পেন্ডুলামের নিচে ক্রমশ তার পরিধি বাড়াচ্ছে। মন্ত্রের মতো, শ্লোকের মতো, ধ্বনির মতো সেখান থেকে একটা আওয়াজ উঠে আসছে। আজও এই শব্দের পাঠ উদ্ধার করতে পারিনি আমি, আজও সেই মৃত শরীরের থেকে নেমে আসা দেহাংশ কৃত বৃত্ত আমাকে পেঁচিয়ে ধরে, মধ্যরাতে সে আমাকে ডাকে, মৃদুস্বরে কিছু বলতে চায়। এর অনেকদিন পরে ওদের পাশের বাড়ির মধু পিসি একদিন আমার খুড়তুতো দিদিকে কলোনির পুকুরে স্নান করতে এসে গল্প করেছিল রঞ্জনের মৃত্যুর। ক্ষুধার কাছে পরাজিত এক মায়ের গল্প ছিল সেটা। দারিদ্রের কাছে পরাজিত স্বামী হারা এক নারীর ক্রমশ ভোগ্য মাংস মাত্র হয়ে যাওয়ার গল্প। কোনো সন্তান তার জন্মদাত্রীকে বিক্রয়যোগ্য মাংস হতে দেখতে পারে না। দিদি যখন স্নানের ঘাট থেকে ফিরে এসে আমাকে আড়ালে ডেকে এই গল্প করলো, মনে আছে আমি সারাদিন মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেছিলাম। মাকে কিচ্ছু বলিনি, শুধু কেঁদেছিলাম। কী আশ্চর্য, মা একবারও জানতে চায়নি কেনো কাঁদছি।
এরপর বেশ কিছুদিন বাসায় আটকে থাকলাম। বাড়ির নিষেধ ছিল না, কিন্তু নিজের ভেতর একটা ভয়, ভয়ার্ত যন্ত্রণা আমার মনের সমস্ত সাহস ও ইচ্ছেগুলো লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই রাত থেকে প্রবল জ্বর, মা পরে বলেছিল যে, সারারাত আমি ভুল বকে গিয়েছি, চিৎকার করে উঠছিলাম– ‘দড়িটা আমার দেহ থেকে খুলে দে, আমি পারছি না’। পরদিন আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক বিনোদ জেঠু এলেন। এল এম এফ বিনোদ প্রামাণিক, আমাদের এলাকার সবার চিকিৎসা প্রথমে তিনিই করেন, আমাকেও দেখলেন। একটা কাচের শিশিতে লালচে একটা সিরাপ দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু তিনদিন পার হয়ে গেলেও জ্বর কমার লক্ষণ নেই। ঠাকুমা মাঝে মাঝেই এসে দেখে যেতেন, বসে থাকতেন মাথার সামনে আর বাবা-মা আমার প্রতি নজর দিচ্ছে না বলে তাদের বকাবকি করতেন। এটা ওটা ভেষজ চিকিৎসার তুকতাক করে যেতেন। কখনো পেয়ারার বা শেফালির পাতার রস, কখনো হাতে পায়ে সরষের তেল কালোজিরা রসুনসহ গরম করে মেখে দিতেন। কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমে না। ছোট কাকু রাগত স্বরে বললেন, এল এম এফ দিয়ে হবে না, হাসপাতালে নিয়ে যা ওকে। যথারীতি পরদিন আমার সেই জনকল্যাণ হাসপাতাল। দেবী ডাক্তার প্রতিদিন সকাল ৮টায় আউটডোরে বসেন। সেখানেও আবার সেই রঙিন সিরাপ। জ্বর কমে না, চারদিকে আমার অসুস্থতার খবর রটে গিয়েছিল ততদিনে। একদিন সকালে জহুরি তালমা থেকে আমাদের জমির এক আধিয়ার সঙ্গে করে এক ফকিরকে নিয়ে এলো। কালো জোব্বা পরা, হাতে ময়ূরের পালকের ঝাঁটা। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে যাচ্ছে সে। দেখেই বুক ধড়ফড় আমার। তার সামনে আমাকে একটা পিঁড়ির উপর বসানো হলো। এরপর তিনি সেই পালকের ঝাঁটা পিঠে বুকে বুলিয়ে চললেন। মাকে একটা ছোট পাথরের বাটিতে তেল ভরে নিয়ে আসতে বলা হলো। সেই তেলভর্তি বাটি তাকে দেওয়া হলো। বাটিটি পশ্চিমদিক করে আকাশের দিকে তুলে তার উপরিতলে জোড়ে ফুঁ দিলেন তিনি। এরপর আমার সামনে সেই ফুঁ দেওয়া বা মন্ত্রপূত বাটিটি নিয়ে আসা হলো। সেখানে বুদ্বুদ ফেনার মতো ভাসছে, ভাসমান ফেনা ক্রমশ একটা আকৃতি নিলো তেলের তলের উপর, অনেকটা মানুষের খুলির মতো, আকাশে ভাসমান মেঘ যেমন নানা আকৃতি নিয়ে ভাসে। ওই ফকির ঠাকুমাকে ডেকে বললেন, ‘এই যে এই জিন তোর নাতির উপর ভর করেছে। আমি একে ছাড়িয়ে দিলাম। এবার প্রতিদিন এই তেল মালিশ কর, জ্বর আসবে না আর।’ সে চলে যাওয়ার পর সেই তেল মাখার নিদান পালন করা হবে কি হবে না তাই নিয়ে চললো তুমুল তর্কবিতর্ক। মা বিপক্ষে, কাকা বিপক্ষে, ঠাকুমা কোনো পক্ষে নেই। জেঠিমা পক্ষে, বাবা পক্ষহীন। কিন্তু সংসারের বড় বলে জেঠিমার মতামত মেনে নিয়েই সেই তেল মাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। দিন চারেক তিনি সাতসকালে সেই তেল মাখিয়ে দিতেন বুকে পিঠে। চারদিন পরে সেই তেলযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই বা ঔষধের কারণে আমি জ্বরমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। খুব ছোটবেলায় এই যে যুক্তি, বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান ও যুক্তিহীনতার আবেগ ও দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখেছিলাম–এটা পরবর্তীকালে আমাকে অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছিল, যা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তির পক্ষে ও বিজ্ঞানের পক্ষে ছিল। কুসংস্কারের বিপক্ষে সক্রিয়তা আবশ্যিক, এটা সেদিন থেকেই মনেপ্রাণে মানি। হয়ত এই থেকেই আমাদের এলাকায় একটা বিজ্ঞান ক্লাব করার অনুপ্রেরণা জন্মেছিল আমার ও বন্ধুদের মনে।
আমার ঠাকুমার নাম স্নেহলতা, আমাদের গোটা পরিবারের মাথার উপরে বটবৃক্ষ তিনি। বটগাছের কথায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই উত্তর বাংলার গ্রামগুলোর ছবি। সেখানে বট একা নয় সঙ্গী থাকে পাকুড় গাছ। ঘটা করে সেই বট ও পাকুড়ের বিয়ে দেওয়া হয়। গাছের শরীরে জড়িয়ে দেয়া হয় শাড়ি, গামছা। দুটি গাছ এভাবেই জড়িয়ে পাশাপাশি বড় হয়, বৃক্ষ হয়ে ওঠে। সেই রূপসি পাকুড়ের পাতা পুরুষালি বলিষ্ঠ বটের পাতার সঙ্গে মিলেমিশে ঝরে। আমাদের এই মানব মানবী বট পাকুড়ের একসাথে বৃক্ষসম হয়ে ওঠা হয়নি। আমি আমার ঠাকুরদাকে দেখিনি, শুনেছি তিনিও সংসারের হাল এই স্নেহলতার কাঁধে দিয়ে নানা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। তিনি খুব রাশভারী ছিলেন বলে কেউ বলেননি, আমি বুঝতাম ঠাকুমার ছায়ার আড়ালে ঠাকুরদা হয়ত হারিয়েই গেছেন। ছোট কাকুর কাছে শুনেছি দাদু মুন্সিগঞ্জের মালখানগরের স্কুল থেকে পাশ করেই একটা চাকরি জুটিয়ে নওগাঁ চলে যান, তারপর চলে আসেন পাহাড়ে। আবার ফিরে যান দেশের ভিটার কাছে। এভাবে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো মানুষটার ছয় সন্তানের পড়াশোনা থেকে যুবতী দেখভালের দায়িত্ব একাই সামলেছিলেন আমার ঠাকুমা। এই যে ঠাকুরদার এখানে সেখানে বেড়িয়ে বেড়ানো রহস্যময় জীবন এর কোনো বাসাবাড়ি ছিল না। শেষ জীবনে তিনি দার্জিলিংয়ে ছিলেন, পোস্ট অফিসে চাকরি নিয়ে। আমার মধ্যম জ্যাঠাকে ঠাকুমা তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেজ জ্যাঠাকে সেনায়। আর ছোট কাকা একটা প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারি নিয়ে জঙ্গলঘেরা মাদারী হাটে। বাবার ছিল কাঠের ব্যবসা। এই নানা গড়নের ও রঙের ‘রায় বাড়ি’র মূল সুতোটা তিনিই ধরে রেখেছিলেন, আমার ঠাকুমা।
আমাদের ‘রায় বাড়ি’র প্রতিটি সন্তানের শৈশব জুড়ে ওই কালো পাড় সাদা শাড়ি পরা ঠাকুমা, যিনি তার বার্ধক্যে এসেও পরিশ্রমের তোয়াক্কা করতেন না। সবদিকে নজর ছিল তার। সবদিক সামলেও আমাদের জন্য তার আলাদা সময় থাকতো, সেখানে কখনো কাটছাঁট করতে দেখিনি কোনোদিন। আমরাও সময় সুযোগ দেখে তার গা-ঘেসে থাকতাম। গল্প বলতেন, মুড়ি মাখতেন, জ্বর এলে বুকে পিঠে তেল কালোজিড়ে রসুন গরম করে মেখে দিতেন, বাবা কাকারা আমাদের বকলে তাদেরই বকে দিতেন। ঠাকুমার গল্পের অধিকাংশটাই ছিল ‘দেশের গল্প’। হারানো কুয়োতলার, গোয়ালঘরের, পুকুর পারের, মেলার, তার সখীদের কথা, তাদের ছেলেমেয়ের কথা এবং অনেকটা জুড়েই ঠাকুরদার কথা। ঠাকুমার প্রতিটি কথাই শেষ পর্যন্ত কোনো এক নীতিবাক্যে এসে থামতো। আমাদের রায়বাড়ির একমদ্বিতীয়ম স্নেহলতা ছিলেন আমাদের জীবন্ত মঙ্গলকাব্য, আমাদের দৈনন্দিনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। তিনি বলতেন ‘রূপ দেখলেই হয় না গুণ থাকতে হয়’। সেই শৈশবে আমরা সেই শীতকালের গুণ খুঁজতাম। লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার আরাম, পিঠে পায়েসের স্বাদ নাকি কুয়াশায় ল্যান্ডস্কেপ, শীতের সকালের রোদ্দুর–আতিপাতি করে খুঁজতাম শীতের গুণগুলো মানুষ চিরকাল তার সংস্কার বহনের চেষ্টা করে যায়, সচেতনে অবচেতনে। দেশভাগের পরও অন্যান্য লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো আমার ঠাকুমাও প্রাণপণে চেয়েছিলেন আজীবন পালন করা অসাম্প্রদায়িক আচার বিচার সংস্কারকে ধরে রাখতে।
ঠাকুমার দুজন সখী ছিলেন, একজন ছিলেন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালির, তাকে জানতাম বেণুর মা পিসি বলে। তারও স্বামী মারা যান দেশভাগের আগেই, দাঙ্গায়। তিন সন্তানকে নিয়ে সীমান্ত পাড় হয়ে চলে এসে এদিকের কোনো এক গ্রামের দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। কিন্তু গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে শহরে চলে আসেন। এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করা আর স্টেশন সন্নিহিত পরিত্যক্ত বাড়ির দালানের এক ভাঙা খুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশভাগের সময় ছেড়ে যাওয়া বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারের পরিত্যক্ত সেই ইমারত পরে ভাটিয়া বিল্ডিং নামে পরিচিত হয়। ভাটির দিক থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আস্তানা। এহেন বেণুর মা পিসির ছিল অগাধ গল্পের ভাণ্ডার। সব গল্প উত্তম পুরুষে, কেন্দ্রে তিনি ও তার অভিজ্ঞতা। প্রতিটি গল্পের শেষে মৃত্যুর কথা, লুটের কথা, হত্যার উৎসবের কথা লুকিয়ে থাকতো। তিনি চলে গেলে মা বলতেন বিণুর মায়ের সার জীবন শুধু কান্নার, তাই সে কান্নাকেই পেঁচিয়ে রাখে নিজের সঙ্গে, খুব দুঃখী মানুষটা। আমরা কান্নাগুলো সরিয়ে রেখে স্নেহটা নিতাম। ঠাকুমার মতো বিণুর মা পিসিও কোনোদিন কোনো নেমত্তন্ন বাড়ি বা উৎসব বাড়িতে যায়নি। ঠাকুমা বলতেন যে, আমাদের যাবতীয় উৎসব সাতচল্লিশে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি। অন্যজন আয়েশা মাসি। স্বামী সন্তান হারানো আয়েশা মাসির চারকুলে কেউ ছিল না। স্কুলে ঝাট দিয়ে, হাসপাতালে আয়ার কাজ করে পেট চালাতেন।
এই ঠাকুমার বয়স নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকলেও এর সঠিক হিসাবটা কেউ জানতো না। একদিন খুব সকালে বাড়ি জুড়ে হইচইয়ে ঘুম ভাঙল। দেখালাম প্রামাণিক ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ঠাকুমার ঘরের দিকে ছুটছেন, পেছনে তার ব্যাগ নিয়ে ছোট কাকু। মা বললেন, গত রাত থেকে ঠাকুমার বমি হচ্ছে, জ্ঞান হারিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার জেঠু বারান্দায় এসে বাবা কাকাদের ডাকলেন। তার কথায় যা মনে হল ঠাকুমার অসুস্থতা গুরুতর। সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বড়দা ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। সদর হাসপাতালে হয়ত টেলিফোন ছিল, কিন্তু আমাদের কলোনিতে কারো টেলিফোন ছিল না। স্কুলে একটা আছে, কিন্তু সে তো বন্ধ তখনও। প্রায় আধঘণ্টা পরে অ্যাম্বুলেন্স এলো। আমরা সবাই যে যার ঘর ছেড়ে বারান্দায় বসে আছি। একে একে আসে পাশের বাসাগুলো থেকে মানুষজন আসছেন, ভিড় বাড়ছে। বাবা কাকারা ধরাধরি করে ঠাকুমাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাচ্ছেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ঠাকুমারও অসুখ হয়! ঠাকুমাও জ্ঞান হারান!
প্রায় একসপ্তাহ পরে ঠাকুমাকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনা হলো। উত্তরের দিকের বড় ঘরটায় তাকে তোলা হলো, আপাতত ওই ঘরে আমাদের প্রবেশে কড়াকড়ি জারি হল। সন্ধ্যায় চুপি চুপি সে ঘরে গেলাম। ঠাকুমা একটা হাত বুকের উপর দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন, অন্য হাত শরীরে আড়াআড়ি রাখা, সেখানে তখনো নল ঢুকানোর ব্যবস্থা রয়ে গেছে। আমাদের উপস্থিতি ঠাকুমা বুঝতে পারলেন, মুখে একটা হাসি এনে তাকালেন। দৃষ্টি আছে দাপট নেই, আমার ভেতরটায় কান্না দলা পাকিয়ে উঠলো। এরপর প্রতিদিন বিকালে, স্কুল থেকে এসেই ঠাকুমার পাশে গিয়ে বসতাম। হাতে হাত বুলিয়ে দিতাম, আর ঠাকুমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। আমি তুলো দিয়ে সেই অশ্রু মুছিয়ে দিতাম। ভাবতাম, যে মানুষটা ভিটাচ্যুত হয়ে কাঁদেননি, সন্তান হারিয়ে কাঁদেননি, তিনি নিজের শারীরিক ক্ষমতা হারিয়ে আজ কাঁদছেন।
মাস তিনেক পরে ধীরে ধীরে ঠাকুমার শরীরের অবস্থা ক্রমশ উন্নতি হতে লাগলো। কিন্তু কোমরের নিচের অংশ শক্তিহীন। সেখানেই ধরে ধরে তুলে মা জেঠিমা পালা করে স্নান করাতেন। স্নানের পরে পিঠে, গলায়, বুকে পাউডার দিয়ে দিতেন। ঠাকুমা ধীরে ধীরে তখন কথা বলতে পারছেন। হাত দিয়ে খেতে পারছেন। স্কুল ফেরত আমি একদিন তার বিছানার পাশে বসে আছি। তিনি তার টিনের ট্রাংকটা খুলতে বললেন। সেটি ঠাকুমার পুরোনো ঘরে ছিল। সেখানে শাড়ি দিয়ে জড়ানো একটা রামায়ণ। কৃত্তিবাসী রামায়ণ। আমাকে সেটি বের করে লব-কুশের অংশটি পড়ে শোনাতে বললেন। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তাই পড়তে অসুবিধা হলো না। এভাবেই শুরু হলো আমার প্রথম রামায়ণ পাঠ, আমাদের বটবৃক্ষের ছায়ায়।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়