শাহানা হুদা রঞ্জনা
ভাবতে অবাক লাগছে খতনার মত প্রাচীন ও প্রচলিত একটি বিষয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রিক দুর্বলতা নিয়ে শেষপর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হলো। মেডিক্যাল সায়েন্সের সবচেয়ে সহজ এই পদ্ধতিটি নিয়ে কেন এত বিপর্যয় হচ্ছে, সম্প্রতি রাজধানীতেই পরপর দুটি শিশু মারা গেল কেন? অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেখা যাক চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) তদন্ত করে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ধারণা করা হয় প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে মিশরে খতনা প্রথা চালু হয়েছিল। আমাদের দেশে শত শত বছর ধরে গ্রামের প্রায় নিরক্ষর হাজামরা এই খতনা করে আসছেন। তারা কোনও ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেয়া ছাড়াই কয়েকশো বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন। হাজামরা এমনভাবে খতনা দেন যে দেখলে মনে হবে তারা খুব অস্বাস্থ্যকর এবং অবৈজ্ঞানিক কায়দায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন। কিন্তু দেখা যায় তারা বেশ সহজভাবেই পরীক্ষায় পাস করে যান, তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনার অভিযোগ ছাড়াই।
দুটি শিশুর মৃত্যুর পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারির সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, খতনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোর খবর পেয়ে অনেকে বলেছেন হাজামের কাছে খতনা করা ভালো। হাজামের কাছে অনেকে যায়, তাদের কিন্তু জটিলতাও হচ্ছে। আমাদের এখানে অনেক গুরুতর রোগী আসে, অনেকে মারাও যায়। এতে প্রান্তিক ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান থাকে, তাই তাদের নিয়ে আলোচনা হয় না। আর তাই সেই কথা কেউ জানেও না।’
গত কয়েক দশকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে সার্জারির মাধ্যমে খতনা করানোর চল বেশ বেড়েছে, বিশেষ করে শহরে। আধুনিক মানুষ হাজামের উপর ভরসা করতে পারছেন না। যেহেতু এটা একধরনের সার্জারি, তাই তারা চিকিৎসকদের কাছেই যাওয়াটা নিরাপদ মনে করছেন। জেলা শহরগুলোতে ও গ্রামে অবশ্য এখনো হাজাম দিয়েই খতনার কাজটি চলছে।
খতনা করাতে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে আহনাফ তাহমিদ নামে দশ বছর বয়সী একটি শিশু মারা গেছে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিছুদিন আগেও আরেকটি শিশু মারা গেছে। দুই পরিবারই অভিযোগ করেছেন যে অনুমতি না নিয়েই তাদের ছেলেকে ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেয়া হয়েছে। প্রশ্নটা ঠিক এখানেই খতনা করানোর সময় ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া কতটা জরুরি এবং কে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন?
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যেহেতু এটা একটা সার্জারি এবং শিশু নড়াচড়া করতে পারে খতনা করানোর সময়, তাই অ্যানেসথেসিয়া দেয়া হয়। দেশে শিশুদের যত খতনা করা হয়, তার ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া দেওয়া হয়। বাচ্চারা সাধারণত তাদের সমস্যা বলতে পারে না এবং কো-অপারেটিভ হয় না। তাই জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়, যাতে সার্জন ভালোভাবে কাজটা করতে পারেন এবং রোগীও ব্যথা না পায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে শিশুর খতনা করানোর জন্য অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার দরকার রয়েছে। “কিন্তু কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া দরকার, সেটি নির্ধারণ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকঠাক শারীরিক পরীক্ষা না করে ভুল সময়ে ভুল অ্যানেসথেসিয়া দিলে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। দিল্লীর একটি হাসপাতালে ল্যাপ্রস্কপি করে ইউটোরাসের ফাইব্রয়েড অপসারণ করার জন্য গেলাম। এর কয়েকমাস আগেই আমার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল। সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তারা বিভিন্নধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। এরমধ্যে ঘন্টা দুয়েক কথা বললেন আমার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তার পুরো টিম নিয়ে। এই ঘটনা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কারণ এর আগে আমার নিজের ও পরিচিত যাদের অপারেশন হয়েছে, কারোরই অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি।অপারেশনের ঠিক আগে ওনারা আসেন, সুই ফুটিয়ে কাজ সেরে চলে যান। স্বভাবতই বিস্মিত হয়ে আমি তাদের কাছেই জানতে চাইলাম অ্যানেসথেসিওলজিস্ট কেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার শারীরিক সুবিধা-অসুবিধা, পারিবারিক রোগ-বালাইয়ের খোঁজ নিলেন?
ওনারা বললেন এনেসথেটিক ড্রাগস সিলেকশন এবং ডোজ, রোগীর বয়স, ওজন ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হয়। কারণ যখন জেনারেল এনেসথেসিয়া দেওয়া হয়, তখন দীর্ঘসময় লাগতে পারে বলে তা হৃদযন্ত্র, ব্রেইন ও শ্বাস গ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারে। সেজন্যই আমরা পেশেন্টের সাথে কথা বলে ও মেডিকেল রিপোর্ট দেখে জেনে নেই তার কোনো শারীরিক জটিলতা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা আছে কিনা। তোমার অন্যান্য রোগ যেমন কাশি, সর্দি, এজমা ও বাবা-মায়ের রোগের ইতিহাস যাচাই করে বুঝতে চেষ্টা করছি কোনো ওষুধে তোমার কোনো নিষেধ আছে কিনা। এগুলো না দেখলে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হওয়া, শ্বাসকষ্ট, এমনকি শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই রোগির হিস্ট্রি নেয়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক।
এখন বুঝতে পারছি সম্ভবত এরই কোনো একটির কারণে খতনা করাতে গিয়ে শিশু দুটি মারা গেছে। আমার পরিচিত একজন ব্যাংককে গিয়েছিলেন একটি বড় সার্জারির জন্য, তারও সেই অভিজ্ঞতা অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে নিয়ে। অপারেশনের আগে ওর সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে নেয়া হয়েছে। এরমানে ভালো চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে এটা একটি অতি আবশ্যিক বা অবশ্য পালনীয়। আমি জানি না বাংলাদেশে কারো কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে দেখার ও তার সঙ্গে কথা বলার।
খতনা করতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর পর আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অপারেশনের সময়, আইসিইউতে পেইন ম্যানেজমেন্ট ও প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অথচ আমরা অপারেশনের আগে শুধু সার্জনকেই চিনি, তার সাথেই কথা বলি। জানতেই পারিনা অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে এবং উনিও জানতে পারেন না রোগীর পুরো হালহকিকত কী?
অ্যানেসথেসিয়া নিয়ে এখন অনেক কথা উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, শিশু দুটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ব্যবহৃত জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে পুরোপুরি অজ্ঞান করার কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। দুটি সার্জারির ক্ষেত্রেই সার্জারি করেছেন অ্যাডাল্ট সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট । শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, পেডিয়াট্রিক সার্জনের দক্ষ টিমের অধীনে প্রটোকল মেনে খতনা না করায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বড় দুর্ঘটনা এড়াতে পেডিয়াট্রিক সার্জন ও পেডিয়াট্রিক অ্যানেসথেসিওলজিস্টের টিম দেখে, ভালো হাসপাতালে শিশুদের খতনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যে হাসপাতালে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও এনেসথেসিয়া ইকুইপমেন্ট-সাপোর্টিভ মেডিসিন আছে। সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ বা যেসব বেসরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক সার্জারি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেসব হাসপাতালে খতনা বা এ ধরনের সার্জারিতে মৃত্যুর ঘটনা কম ঘটে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের কতজন অভিভাবক জানেন যে খতনার মতো সহজ একটি সার্জারি করতে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়, কতজন জানেন যে খতনার আগে শিশুর সার্বিক শারীরিক অবস্থা ডাক্তারকে জানাতে হয় এবং সর্বোপরি কয়জন জানেন যে কোন কোন হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক সার্জন ও পেডিয়াট্রিক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন?
অপরদিকে ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ও হাসপাতালগুলোও নিজেদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও কাঠামোর দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে রোগীকে কিছু জানায় না। অনেক চিকিৎসক অভিযোগ করেন যে অবচেতন করার আগে রোগীর লোকজন বলেন না কেন রোগীর এই সমস্যা আছে, ওই সমস্যা আছে। অপারেশনের সময় রোগীকে এনেসথেসিয়া প্রয়োগ করার আগে রোগীর অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা, থাকলে সেটা জানানো বা জেনে নেয়ার দায়িত্ব কার? এবং খতনা করার সময় অ্যানেসথেসিয়ার প্রসিডিউর কি এটা জানা নিশ্চয়ই পেশেন্ট পার্টির দায়িত্ব নয়।
যেকোনো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একটা চেইন ধরে কাজ করে। এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর একসাথে জড়িত। এরমধ্যে কোনো একটি ফ্যাক্টর কাজ না করলে বা দুর্বল হলে অন্য ফ্যাক্টরগুলোও ঝামেলার মধ্যে পড়তে বাধ্য। আমাদের দেশে মানুষের অনুপাতে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা কম, চিকিৎসক কম, ওষুধপত্র-যন্ত্রপাতি কম এবং নার্সেরও অভাব রয়েছে। অসংখ্য রোগীর চাহিদা মেটাতে এরা হিমশিম খাচ্ছেন। এর উপর আছে দায়িত্বে অবহেলা, চুরি, অযত্ন এইসব। সবকিছু মিলেমিশে পুরো ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
এখানে কারো একার কোনো দায় বা দোষ নেই। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও তো অনেক অভিযোগ আছে। সেখানে টাকা দিয়েও রোগী কেন ভালো সেবা পান না? কেন দায়িত্বপালনে এত গাফিলতি হয়? কেন প্রায়শই পেশেন্ট পক্ষ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের সাথে ঝামেলা ও হইচই বাধে, সেটা তদন্তের দাবি রাখে।
পত্রিকায় দেখলাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকার কথা। অথচ সরকারি চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশে প্রতি লাখে একজনেরও কম অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রয়েছেন। সরকারি হাসপাতালের বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে আরো কিছু সংখ্যক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এক তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে নিয়মিত নিয়োগ না হওয়া এবং বেসরকারি খাতেও চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ায় অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংখ্যা বাড়ছে না দেশে, যার প্রভাব পড়ছে চিকিৎসাসেবায়।
সত্যি কথা বলতে কী সাধারণ মানুষের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না। আর তাই হয়তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের বেশ কদর থাকলেও বাংলাদেশে তেমনটি নয়। এখানে তাদের সুযোগ-সুবিধা কম, চাকরির সংখ্যাও কম। বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি বলেছেন, সরকারি অনেক হাসপাতালে এই পদ খালি রয়েছে। সুযোগ-সুবিধা ও চাকরির সুযোগ সীমিত থাকার কারণেই অনেকের আগ্রহ থাকলেও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন না।
আমরা অনেকেই জানতাম না এবং এখনো জানিনা যে রোগীর অস্ত্রোপচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট। খতনা করতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর পর আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অপারেশনের সময়, আইসিইউতে পেইন ম্যানেজমেন্ট ও প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অথচ আমরা অপারেশনের আগে শুধু সার্জনকেই চিনি, তার সাথেই কথা বলি। জানতেই পারিনা অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে এবং উনিও জানতে পারেন না রোগীর পুরো হালহকিকত কী?
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।