২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

বেইলি রোডে আগুন এই মৃত্যুকূপেই আমাদের বাস করতে হবে?

প্রভাষ আমিন
চার বছর পর পর লিপইয়ার আসে। মানে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের বদলে ২৯ দিনে হয়। বাড়তি একটি দিন বিশ্বজুড়েই উল্লাস নিয়ে আসে। ২৯ ফেব্রুয়ারি যাদের জন্ম, তাদের জন্মদিন পালন করার জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে মজা করে ২৯ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন। এবার ২৯ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিনে বছরের বোনাস পাওয়া দিনটিতে অনেকেই সপরিবার, সবান্ধব রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন। সেই যাওয়া যে অন্তত ৪৬ জনের শেষ যাওয়া হবে, অনেকের জীবনে যে স্থায়ী বিভীষিকা বয়ে আনবে; কেউ নিশ্চয়ই ভাবেননি।
ঢাকার খুব জনপ্রিয় রাস্তার একটি হলো বেইলি রোড। ঢাকার মঞ্চনাটকের প্রাণকেন্দ্র এই বেইলি রোড। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ মিলনায়তনেই মঞ্চস্থ হয় অধিকাংশ মঞ্চনাটক। ইদানীং বেইলি রোডে খাবার দোকানের আধিক্য হয়েছে। তেমনই একটি রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং ‘গ্রিন কোজি কটেজ’। ৭ তলা ভবনটিতে ৮টি রেস্টুরেন্ট। রাত পৌনে ১০টায় যখন আগুন লাগে, তখন পুরো ভবনটি ছিল আলো ঝলমলে ও জমজমাট। হঠাৎ করেই যেন কেয়ামত নেমে এলো সেখানে। প্রথম যখন আগুন লাগার খবর পাই, তখনই বুঝিনি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে আগুন এমন প্রাণঘাতী হতে পারে। পরে যখন একের পর এক মৃত্যুর খবর এলো, তখন শোকের ছায়া নেমে এলো ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশে।
ঠিক আগের দিন রাতে এটিএন নিউজের নিয়মিত টক শো’তে আমার অতিথি ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুজ্জামান। ফেসবুকে দেখলাম, তিনি সপরিবারে আটকা পড়েছেন সেখানে। অধ্যাপক কামরুজ্জামানের মেয়ের জন্মদিন ছিল ১ মার্চ। তাদের পরিকল্পনা ছিল রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে রাত ১২টায় জন্মদিনের কেক কেটে বাসায় ফিরবেন। ভাগ্যগুণে তারা বাসায় ফিরতে পেরেছেন, তবে মনে স্থায়ী বিভীষিকা নিয়ে। অধ্যাপক কামরুজ্জামানের মেয়ে তাকে বলছিল, বাবা, জন্মদিনেই কি আমার মৃত্যুদিন হবে। ছাদে চলে যেতে পেরেছিলেন বলে অধ্যাপক কামরুজ্জামানের পরিবার বেচেঁ গেছেন বটে, তার মেয়ের জন্মদিন হয়তো মৃত্যুদিন হয়নি। কিন্তু অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যুদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি।
একটা দুর্ঘটনায় কত বেদনার ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি নাসিরুল ইসলামের স্ত্রী মারা গেছেন ২০১৮ সালে। তারপর থেকে দুই মেয়েকে নিয়েই তার সংসার, তার স্বপ্ন। মেয়ে লামিসা ইসলাম বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বপ্ন যখন হাতের মুঠোয়, তখনই তা বদলে গেলো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে। লামিসা বাঁচার আকুতি জানিয়ে বাবাকে ফোন করেছিলেন। শত মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো নাসিরুল ইসলাম তার মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি।
ইতালিপ্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন মাসখানেক আগে দেশে ফিরেছিলেন স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে যেতে। তাদের ইতালি যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। ২২ মার্চের টিকিটও কাটা ছিল। বিদায় নিতে ১ মার্চ তাদের গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের ইতালি বা গ্রাম কোথাও যাওয়া হয়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক লুৎফুন নাহার মেয়েকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন গ্রিন কোজি কটেজে, আর ফেরা হয়নি। এমন কত স্বপ্ন পুড়ে গেলো নিষ্ঠুর আগুনে। ভবনের নিরাপত্তাকর্মী, ডেলিভারি বয়; এমন অনেকেরই প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আগুন।
আগুন লাগার পর অনেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে চেয়েছিলেন, পারেননি। কারণ আগুনের উৎস ছিল সিঁড়িতেই। যারা ছাদে উঠতে পেরেছেন, তারা বেঁচে গেছেন। যারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। যারা মারা গেছেন, তারা কেউ কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যাননি। তাদের প্রাণ গেছে ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে। কি ভয়ঙ্কর কষ্টকর মৃত্যু, তিলে তিলে মৃত্যু। শেষ নিশ্বাসটাও তারা শান্তিতে নিতে পারেননি। স্বজনদের ফোন করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। অসহায় স্বজনরাও চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, কিছুই করার ছিল না। আমি খালি ভাবছি, যারা মারা গেছে, তারা কি মৃত্যুর আগে আমাদের, মানে এই রাষ্ট্রকে, এই ব্যবস্থাকে অভিশাপ দিয়ে গেছেন।
এটা দুর্ঘটনা বটে। আগুন লাগতেই পারে। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার সব রাস্তা আমরা বন্ধ করে রেখেছি। ঢাকা যেন এক মৃত্যুপুরী। আগুন লাগলেই এখানে মৃত্যুর মিছিল। আমাদের দেশে মানুষ বেশি, তাই মনে হয় মানুষের জীবনের দামও কম। জীবনের চেয়ে জীবিকাই আমাদের এখানে প্রাধান্য পায়। গ্রিন কোজি কটেজটি বাণিজ্যিক ভবন বটে, তবে এখানে রেস্টুরেন্ট করার অনুমোদন ছিল না। এ নিয়ে নাকি তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছে। নোটিশ দেওয়া হয়েছে বটে, তবে বন্ধ করা হয়নি।
শুধু বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজই নয়, ঢাকায় এমন আরেও অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ভবন আছে। খিলগাঁও, বনানী, গুলশান, ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে এমন অনেক ভবন আছে, যার পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। সন্ধ্যার পর পুরো ভবন ঝলমল করে আলো আর মানুষের পদচারণায়। কোনো তদন্ত ছাড়াই বলে দেওয়া যায় প্রতিটি ভবনই আসলে একেকটি মৃত্যুকূপ, প্রতিটিই একেকটি গ্রিন কোজি কটেজ। আমাদের ভাগ্য ভালো আগুন মাঝে মাঝে লাগে। যে কোনো দিন যে কোনো ভবনে আগুন লাগতে পারে। আর আগুন লাগলে সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় থাকবে না।
গ্রিন কোজি কটেজে একটা প্রপার ফায়ার এক্সিট থাকলে ৪৬ জন মানুষকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না। সাধারণ বাণিজ্যিক ভবন আর রেস্টুরেন্ট ভবনে পার্থক্য আছে। রেস্টুরেন্ট মানেই সেখানে আগুন থাকবে, সিলিন্ডারের নামে বোমা থাকবে। তাই সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতেই হবে। কিন্তু ঘটনা হয় উল্টো। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ধানমন্ডির অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট ভবনের সিঁড়ি অকেজো। মানে রেস্টুরেন্ট মালিকরা সিঁড়িকে তাদের স্টোর রুম বা কিচেনের অংশ বানিয়ে রেখেছে।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডিতে মামলা হয়েছে, রেস্টুরেন্ট মালিকদের কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু আমি জানি শেষ পর্যন্ত কারও কিছুই হবে না। নিমতলি, চুড়িহাট্টা, এফ আর টাওয়ারের ঘটনায় কারও কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। আসলে এ মৃত্যু উপত্যকায় আমাদের দেশ। এই মৃত্যুকূপেই আমাদের বাস করতে হবে। স্রেফ ভাগ্যগুণে আমরা বেঁচে আছি। যে কোনো দিন যে কেউ পত্রিকার শিরোনাম হয়ে যেতে পারি।
আগুন তো দূরের কথা, সাধারণ সময়েও চাইলে আপনি সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। দেশ সেরা স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে তার ডিজাইন করা একটি ভবনে মানুষকে যেতে নিষেধ করেছেন। চমৎকার ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে করা হলেও রেস্টুরেন্ট বানানোর জন্য করা নয়। অথচ এখন সেখানে ২৫টি রেস্টুরেন্ট।
ঢাকায় আমাদের সবার চোখের সামনে এমন অনেকগুলো মৃত্যুকূপ আছে। আমরা সবাই জানি। তবুও ঝুঁকি নিয়ে এসব ভবনেই যাই। প্রত্যেকবার আগুন লাগলে আমরা অনেক হৈচৈ করি, দায় চাপানোর চেষ্টা করি। রাজউকের দায়, নাকি ফায়ার সার্ভিসের দায়, নাকি সিটি করপোরেশনের দায়, নাকি মালিকের দায়- এনিয়ে খুব চাপান-ওতোর চলে। কিন্তু কার দায়, তাতে তো ৪৬ জন মানুষের জীবন ফিরে আসবে না।
আমরা জেনেশুনেও ব্যবসায়ীদের চাপে, তাদের জীবিকার কথা ভেবে চুপ থাকি। আর ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রতিটা বড় আগুনের পর আমরা বলি, এ দুর্ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিলো। আসলে চোখ বন্ধই থাকে। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, কেউ জেগে ঘুমালে তাকে জাগানো মুশকিল। নিমতলির ট্র্যাজেডির পর আবার চুড়িহাট্টায় আগুন লাগে। কিন্তু পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরে না।
বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনের পরও আমাদের সুউচ্চ ভবনগুলো নিরাপদ হয় না। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পরও মার্কেটগুলো নিরাপদ হয় না। আমি নিশ্চিত বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পরও অনিরাপদ রেস্টুরেন্টগুলো থাকবে। কয়দিন খুব হৈচৈ হবে। অনিরাপদ ভবনে নোটিশ লাগানো হবে। তারপর সব হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডিতে মামলা হয়েছে, রেস্টুরেন্ট মালিকদের কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু আমি জানি শেষ পর্যন্ত কারও কিছুই হবে না। নিমতলি, চুড়িহাট্টা, এফ আর টাওয়ারের ঘটনায় কারও কিছু হয়েছে বলে শুনিনি।
আসলে এই মৃত্যু উপত্যকায় আমাদের দেশ। এই মৃত্যুকূপেই আমাদের বাস করতে হবে। স্রেফ ভাগ্যগুণে আমরা বেঁচে আছি। যে কোনো তিন যে কেউ পত্রিকার শিরোনাম হয়ে যেতে পারি।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়