প্রতিদিনের ডেস্ক
নগরে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড লাইসেন্স বিতরণের আগে ব্যবসার ধরন, ভবনের বাণিজ্যিক অনুমোদনসহ অন্য বিষয়াদি সরেজমিনে পরিদর্শন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রিন কোজি কটেজের যেসব রেস্তোরাঁকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটিতেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এসব ট্রেড লাইসেন্স বিতরণ ও অবৈধ রেস্তোরাঁ পরিচালনা বিষয়ে একে অপরকে দুষছে সরকারের দায়িত্বশীল দুই সংস্থা রাজউক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটির বাণিজ্যিক অনুমোদন ছিল না বলে দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা যথাযথ নিয়ম মেনেই রেস্তোরাঁগুলোকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু রাজউকই তার মুখ্য ভূমিকা পালন করেনি। এছাড়া এ ঘটনায় সরকারের অন্য সংস্থারও দায় রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দেশে যে কোনো অঘটন ঘটলে রাষ্ট্রে দায়সারা সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এখন বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর তা আবার দেখা যাচ্ছে। এখানে রাজউকের মুখ্য ভূমিকায় থাকার কথা ছিল। এখন তারা নানা অজুহাতে দায় সারতে চাইছে। আবার সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কেউ এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ নগর এলাকার সঠিক পরিকল্পনা, ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ ভবন নির্মাণ, কার্যকরী উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, সেবা সংস্থাগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও নগর উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার মাধ্যমে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড এড়ানো সম্ভব ছিল।
নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকায় যে পরিমাণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষকে বসবাস করতে হয়, বিশ্বের আর কোনো শহরে জীবনের এমন ঝুঁকি নেই। বেইলি রোডের এ অগ্নিকাণ্ড ঢাকায় জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সবার সামনে আনলো। অথচ নগর পরিকল্পনা, ভবনের ডিজাইন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা, ভবনের ব্যবহার, ভবনের অগ্নি প্রতিরক্ষা, ফায়ার ড্রিল, ভবন মালিকের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এবং নগর সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকি থাকলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তাই এটিকে গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এ গাফিলতিতে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।’
রাজউকের বাণিজ্য অনুমোদন
রাজউক সূত্র জানায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনটি আবাসিক কাম অফিস (অকুপেন্সি টাইপ এ-২ এবং এফ-১) হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন ছিল। অর্থাৎ ভবনটি আবাসিক কাম অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, রেস্তোরাঁ নয়। অথচ তারা পুরো ভবনটি রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখন কী কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ পেল এবং কেন এত প্রাণহানি ঘটলো তা খতিয়ে দেখতে রাজউকের সদস্যকে (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
অফিসের বদলে ভবনে রেস্তোরাঁ চালু করা হলেও রাজউক কেন ব্যবস্থা নেয়নি এমন বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘২০১১ সালে একটি বেজমেন্টসহ আটতলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক (এ-২, এফ-১) ভবন হিসেবে গ্রিন কোজি কটেজের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভবনটি নির্মাণ শেষে ২০১৩ সালে ভূমি মালিক হামিদা খাতুনকে হস্তান্তর করে। ২০১৯ সালে ওই ভবনে অভিযান চালিয়েছিল রাজউক। সে সময় ভবন তৈরিতে অনিয়মের কারণে ওই ভবনের অননুমোদিত অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভবনটিতে ছিল না রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ। এজন্য তাদের জরিমানাও করা হয়।
কিন্তু ভবনে কীভাবে রেস্তোরাঁ চালু হলো, রাজউক কেন কোনো ব্যবস্থা নিলো না- এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।
২০১৩ সালে ভবনটি মালিকপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর শুরু হয় বিভিন্ন রেস্তোরাঁর কার্যক্রম। তখন থেকেই তারা ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, ভবনটির নিচতলায় ‘স্যামসাং’ ও ‘গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার’ নামে দুটি ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম বিক্রির দোকান, ‘শেখলিক’ নামে একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও ‘চুমুক’ নামে একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। এর মধ্যে চুমুকের ট্রেড লাইসেন্স ছিল না।
দ্বিতীয়তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামে একটি রেস্তোরাঁ, তৃতীয়তলায় ‘ইলিয়ন’ নামে একটি পোশাকের দোকান, চতুর্থতলায় ‘খানাস’ ও ‘ফুকো’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ, পঞ্চমতলায় ‘পিৎজা ইন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ, ষষ্ঠতলায় ‘জেসটি’ ও ‘স্ট্রিট ওভেন’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ এবং ছাদে ‘অ্যামব্রোসিয়া’, ‘হাক্কাঢাকা’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ ছিল। এসব রেস্তোরাঁর সবকটির ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, যারা লাইসেন্স দিয়েছে তাদের আগে দেখার দরকার ছিল ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার জন্য রাজউকের অনুমোদন আছে কি না, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম (অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা) ঠিক আছে কি না। কিন্তু ডিএসসিসি তার কোনোটিই করেনি। যখন যে প্রতিষ্ঠান এ ভবনে রেস্তোরাঁ করতে চেয়েছে, ডিএসসিসি তাদেরই ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে। অথচ রাজউকের এফ-১ এ ভবনে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন নেই।
বেইলি রোড এলাকাটি ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর আওতাধীন। এ অঞ্চলের লাইসেন্স সুপারভাইজর ইফতেখার আলম বলেন, ‘আমরা ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখি যে ভবনে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা হবে সেটি বাণিজ্যিক ভবন কি না। যদি বাণিজ্যিক ভবন হয় তাহলে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়। অন্যথায় তা দেওয়া হয় না। তবে এক্ষেত্রে রাজউকের বাণিজ্যিক ভবনের যে কয়েকটা ক্যাটাগরি রয়েছে তা আমাদের দেখা হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, ‘ওই ভবনটি কমার্শিয়াল দেখেই আইন অনুযায়ী রেস্তোরাঁর জন্য ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছিল ডিএসসিসি। বাণিজ্যিক হারেই ভবন মালিকদের কাছ থেকে হোল্ডিং কর আদায় করা হতো। তবে রাজউকের উচিত কোন ভবনে কী করা যাবে, আর কোনটা করা যাবে না ভবনের নিচে তার একটা বোর্ড টানিয়ে দেওয়া।’
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর টনক নড়ে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

