১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

কোথাও কোথাও নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল: সংসদে জিএম কাদের

প্রতিদিনের ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ হয়েছে উল্লেখ করে বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের বলেছেন, আইন অনুযায়ী তা বৈধ হয়েছে। কেউ বেআইনি ঘোষণা করেনি। কিন্তু সিংহভাগ মানুষ মনে করে ভালো নির্বাচন হয়নি, সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করে না। কোথাও কোথাও নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল বলেও অভিযোগ করেন জিএম কাদের। তিনি ৪২ শতাংশ ভোট নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে জিএম কাদের এই অভিযোগ করেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে বলে অভিযোগ করে জিএম কাদের বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে তিন ধরনের ইলেকশন হয়েছে। কোনও কোনও এলাকায় সবগুলো সুষ্ঠু ইলেকশন হয়েছে। সেখানে কোনও ডিস্টার্বেন্স হয়নি। সাধারণ প্রতিযোগিতাহীন ইলেকশন হয়েছে। সেখানে কোনও শক্ত প্রার্থী ছিল না। সেখানে সরকারের সদিচ্ছা ছিল। শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। তবে উপস্থিতি কম ছিল। আরেকটা হয়েছে ফ্রি স্টাইল। সেখানে মাসল পাওয়ার (পেশিশক্তি) এবং মানি (টাকা) অবাধে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়েছে। বেশিরভাগ সময় এখানে সরকারি দল এবং বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী বা আমাদের প্রার্থী…। আরেকটা ছিল যেটা নিয়ে ব্যাপকভাবে অভিযোগ আমাদের অনেক নেতা–কর্মী প্রার্থীদের। ইলেকশন যেভাবেই হোক ফলাফল একটা পূর্ব নির্ধারিত ছিল এবং শিট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
সরকারি দলের সদস্যরা ব্যাপকভাবে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকলে জিএম কাদের হেসে বলেন, এটা নাও হতে পারে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, সব দল নির্বাচনে আসে বাধা শুন্যভাবে ভোট হয় সেখানে ১৫ শতাংশ ভোট হলেও তা গ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এই মুহূর্তে ৯০-৯৫ শতাংশ ভোট পড়বে। আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো একটি দল না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা কঠিন। এতে মানুষ ভোটই দিতে আসে না।
নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পড়া সম্ভব কি না তা দেখতে অঙ্ক করেছেন জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, যে প্রেক্ষাপট ছিল তাতে ৪২ শতাংশ ভোট দিতে গেলে সব ভোটকেন্দ্রের সামনে ৮ ঘণ্টা লাইন থাকার কথা। কিন্তু তা ছিল না। …এসময় সংসদ সদস্যরা হইচই শুরু করেন। অনেকে বলেছেন, ঘণ্টায় তিন চারটার বেশি ভোট হয়নি। আমি আমার কথা বলছি না। ধারণার কথা বলছি।’
এ সময়ে সংসদ সদস্যরা হইচই করেন। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে বলতে শোনা যায়, শুনেন না। ধৈর্য ধরেন। জিএম কাদের বলেন, ৪২ যদি দেখানো হয় বাকি ব্যালটগুলো কীভাবে এলো কার পক্ষে এলো?
তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ হিসাবে গণ্য করা যায়। আইন অনুযায়ী তা বৈধ হয়েছে। কেউ বেআইনি ঘোষণা করেনি। কিন্তু সিংহভাগ মানুষ মনে করে ভালো নির্বাচন হয়নি, সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করে না।
তিনি বলনে, আমি মনে করি আইন-কানুন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যারা দেখার কথা তারা এড়িয়ে গেছেন, অনেক সময় লঙ্ঘনে সহায়তা করেছেন।
সংসদ সদস্যরা হইচই করতে থাকলে স্পিকার বলেন, মাননীয় সদস্যবৃন্দ ওনাকে বলতে দিন।এসময় কোনও একজন সদস্যকে বলতে শোনা যায়, জামায়াত-বিএনপি, তারেক রহমান বক্তব্য দিচ্ছে আজকে।
জিএম কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, নির্বাচনে জয় হয়েছে জনগণের গণতন্ত্রের। আমার জানামতে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এ কথার সাথে একমত নয়। এই নির্বাচনে শুধু জয়ী হয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা আছে এমন অন্য সব দল নিজস্ব নীতি আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন স্বাভাবিক রাজনীতি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে আমার আশঙ্কা।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পেরেছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত নয়। মামলা দিয়ে, জেলে বন্দি করা হয়েছে, হুলিয়া দিয়ে ঘর ছাড়া করা হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ধানক্ষেতে, বনে-জঙ্গলে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাদের পক্ষে এমন পরিবেশ ছিল না যে স্বাধীনভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারবেন।জিএম কাদের বলেন, সংবিধান ও আইন যেকোনও ধরনের নির্বাচনকে বৈধতা দিতে পারে। কিন্তু সবক্ষেত্রে তা সঠিক বা ভালো নির্বাচন বলে গ্রহণযোগ্য হবে সেটা সবসময় নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
তিনি বলেন, ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২১ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সব দল নির্বাচনে না এলে ভোট স্বতঃস্ফূর্ত হয় না। খুব গ্রহণযোগ্য হয়েছে সপ্তম, অষ্টম, নবম সংসদ নির্বাচনে— ৭৫ থেকে ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসেনি উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। এটা বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। দুর্নীতি ছাড়া কোনও কাজ হয় না। এটি প্রত্যেক সমাজের অভিশাপ। দুর্নীতির কারণে ভোগান্তি বাড়তে থাকে। এটা সমাজ উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে। সরকার সাধারণত দুর্নীতি স্বীকার করে না। এসময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। এসময় সরকার দলীয় ও অধিকাংশ স্বতন্ত্র এমপি দাবি করেন এটা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত অভিমত।
এসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকের কথা তুলে ধরে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ২০০১ সাল থেকে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। যার প্রথমে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। এসময় সরকার ও অধিকাংশ স্বতন্ত্র এমপিরা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন জিএম কাদের বলেন, চারবার হয়েছে বিএনপির আমলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ১৩তম স্থানে ছিল বলে উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, বর্তমানে আমরা ১০ম স্থানে আছি। মানে দুর্নীতি অবস্থান এখন নিচের দিকে নেমে গেছে। এটা হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট। এসময় সরকার ও স্বতন্ত্র এমপিরা ভুয়া প্রতিবেদন বলে দাবি করেন। জিএম কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণে দুর্নীতির বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আমরা দেখিনি। এসময় পাশ থেকে এক সংসদ সদস্য বলেন ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’। তখন জিএম কাদের বলেন, অবশ্যই মহামান্য রাষ্ট্রপতি।
ঋণ খেলাপির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো কোনও সংগঠন থাকলে সেখানেও বাংলাদেশ ঋণ খেলাপির দিক বিশ্বের ২-১ নম্বরে চলে যেতো বলেও দাবি করেন জিএম কাদের। খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং আইএমএফের হিসাবের গড়মিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। জিএম কাদের বলেন, আইএমএফ ও আমাদের হিসাবে পার্থক্য হচ্ছে কেন? ব্যাংকের অদ্ভুত ব্যাপার, তারা চতুরতা করে নিজেদের খেলাপি ঋণ আদায় না করে কার্পেটের তলে ঢুকিয়ে রেখেছে। জনগণের পয়সা। তাদের নিজেদের পয়সা না। আমাদের পয়সা নিচ্ছে। যাকে-তাকে দিচ্ছে। তারপর এ পয়সাগুলো দেখাচ্ছে তাদের কাছে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটাকে উৎসাহী করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বলে দাবি করেন জিএম কাদের।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিচারহীনতার উদাহরণ বলে উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য তদন্তকাজকে বিলম্বিত করতে উৎসাহিত করতে পারে। তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক ব্যক্তি আমদানি করছে। এতে সিন্ডিকেট হওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এসব ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারের কাছে বিকল্প না থাকার কারণে সরকার তাদের হাতে জিম্মি বলেও মনে করেন তিনি।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়