প্রতিদিনের ডেস্ক
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নে থাকছে না পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি। ‘নিচের পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে যে কোনও তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে’— এমন ধাঁচের লিখিত প্রশ্নও থাকবে না। পরীক্ষার আগে ঘণ্টা বাজবে না, চাপ নিয়ে বসতে হবে না তিন ঘণ্টার পরীক্ষায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব না থাকলেও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে যথাযথভাবেই।
২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। গেলো বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা না রাখা, এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেওয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য আগের মতো ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা রাখা হয়নি। তার পরিবর্তে ‘শিখনকালীন’ ও বছর শেষে ‘সামষ্টিক’ মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
তবে চিরাচরিত মূল্যায়ন পদ্ধতি ‘পরীক্ষা’ তুলে দেওয়ার পর থেকেই অভিভাবকদের একটি অংশ নতুন এই শিক্ষাক্রম ও নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করছেঠন। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানান, অভিভাবকরা যাতে করে সহজে বুঝতে পারেন, সে জন্য মূল্যায়ন পদ্ধতি সহজ করা হবে। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানদের দক্ষতার জায়গাটা অভিভাবকরাও যাতে বুঝতে পারেন, সে জন্য বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা বাদ দিতে এবং চাপমুক্তভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার স্বার্থেই নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
‘পুরনো ধাঁচের লিখিত পরীক্ষা’ আর থাকছে না
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারে হয়তো বাদ হচ্ছে না, কিছুটা পরিমার্জিত রূপে হলেও পরীক্ষায় বসবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বাস্তবে নতুন কারিকুলামে সেটা হচ্ছে না। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নই থাকছে, চিরাচরিত লিখিত পরীক্ষা থাকছে না। এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার পদ্ধতি। এতে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে মূল্যায়নের সুযোগ নেই।
তবে গতবছর নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হওয়া তিনটি শ্রেণিতে যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়েছে, তারও কিছু কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের আগের মূল্যায়নগুলোতেও লিখিত অংশ ছিল। কোনও বিষয়ের মূল্যায়নে হয়তো একটা রিপোর্ট রাইটিং ছিল, তারা হয়তো ডাটা কালেকশন করেছে, প্রসেস করেছে, অর্থাৎ কারিকুলামে যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবেই হয়েছে। শিক্ষার্থীরা রিপোর্ট লিখেই জমা দেবে, অ্যাসাইনমেন্ট লিখে জমা দেবে। যদি একটা কাজ করে, সেটা লিখেই জমা দেবে। পোস্টার তৈরি করবে, দেয়ালিকার মধ্য দিয়ে তাদের রচনা উপস্থাপন করবে, তাহলে তো লিখিতই হবে। সেরকম লিখিত পাঠ থাকবে। গতবছরের জুন ও ডিসেম্বরে (ষান্মাসিক) যেভাবে মূল্যায়ন হয়েছে, সেখানেও এমনভাবেই হয়েছে।’
‘ঘণ্টা পড়ার চিন্তা’ নিয়ে বসতে হবে না ৩ ঘণ্টার পরীক্ষায়
ঘণ্টা ধরে পরীক্ষায় বসার পদ্ধতি যে আর থাকছে না, তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে এর পরিবর্তে মূল্যায়ন কীভাবে হবে তা নিয়েই চলছে আলোচনা। নতুন কারিকুলাম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু শ্রেণি মূল্যায়নই নয়, এসএসসি পরীক্ষাতেও পরিবর্তন থাকছে।
এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, পাঁচটা প্রশ্ন থাকবে, তার মধ্যে দুইটা বা তিনটার উত্তর দিতে হবে; ইহাকে কী বলে; কী কী— এমন ধরনের প্রশ্ন থাকবে না। ঘণ্টা বাজিয়ে পরীক্ষা হবে না। একদম পরিষ্কার, সেভাবে পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষা যদি হওয়ার কথা বলা হয়, তাহলে কম্পিটেন্সি বেইজ কারিকুলাম বাদ দিয়ে অন্য কারিকুলাম তৈরি করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে লেখার পাঠ আছে। ক্লাসের মধ্যেও লেখার পাঠ আছে। আগে শিক্ষার্থী বই থেকে পড়ে অন্যের (বইয়ের লেখক) ভাষায় খাতায় লিখেছে। বইয়ে যা লেখা ছিল তাই খাতায় লিখেছে। এখন বাচ্চারা তার নিজের ভাষায় লিখবে।’
৫ ঘণ্টায় এক বিষয়ে মূল্যায়ন
মূল্যায়নে পরিবর্তন বা পরিমার্জন কী হবে জানতে চাইলে অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আগে একদিনে ছয়টি সাবজেক্টের মূল্যায়ন করা হতো। আমরা যখন মাঠ পর্যায়ে গেছি, তখন জেনেছি যে একদিনে ছয়টি সাবজেক্টের মূল্যায়ন করতে গেলে তা ঠিকমতো হয় না। তারপর আমরা গত নভেম্বরে যখন পরীক্ষা নিয়েছি তখন একদিনে তিনটা সাবজেক্ট করেছিলাম। আর এখন একদিনে একটি সাবজেক্টের পুরো মূল্যায়ন করা হবে। প্রথমে ওরিয়েন্টশেন দেওয়া হবে, তারপর একজন শিক্ষার্থী ফাইনাল কাজটি করবে। দলগতভাবে একটি কাজ করা হবে, আবার প্রত্যেককে এককভাবে পারফর্ম করতে হবে। প্রতিদিন ৫ ঘণ্টায় এই কাজ করতে হবে।’
পরীক্ষা থাকলেই গাইড-কোচিং ব্যবসা চলবে
এনসিটিবি জানায়, সামষ্টিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষা চাওয়ার কারণ হচ্ছে, গাইড ও কোচিং সেন্টারের মালিকরা এর পেছনে রয়েছে। পরীক্ষা না থাকলে কোচিং ও গাইড চলবে না। পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা থাকলেই কোচিং ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে দেখা যাবে।
বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের ফল
বছর শেষে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মাধ্যমে করা হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। নম্বরের পরিবর্তে ‘ত্রিভুজ’, ‘চতুর্ভুজ’, ‘বৃত্তের’ মতো চিহ্ন ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ফল তুলে ধরা হবে। এনসিটিবি জানায়, অভিভাবকদের কাছে কতটা সহজভাবে মূল্যায়ন ও ফলাফল তুলে ধরা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসএসসি-এইচএসসির মূল্যায়ন
নতুন কারিকুলামে নবম শ্রেণি পর্যন্ত যে মূল্যায়ন হবে একইভাবে পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমানের সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। তবে সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা কেন্দ্র থাকবে, পর্যবেক্ষক থাকবেন, লিখিতভাবে ডকুমেন্টের পাশাপাশি থাকবে অন্যান্য কার্যক্রমও। সব কিছুই থাকবে। কিন্তু যেটা থাকবে না সেটা হচ্ছে আগের মতো প্রশ্নপত্র যার উত্তর মুখস্থ করে এসে লেখা যাবে।
মূল্যায়নে যে কাজটা করতে দেওয়া হবে, তার বর্ণনা হয়তো লিখতে হবে। কিংবা একটা ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ লিখতে দেওয়া হবে। সেটা ওখানেই লিখতে হবে। কখনই আগের মতো হবে না, যে বই থেকে বা গাইড থেকে পড়ে মুখস্থ করে গেলাম আর লিখেদিলাম। শিক্ষার্থীকে কাজটা করতে হবে এবং বর্ণনা লিখতে হবে নিজের মতো করে।
মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে সমন্বয়
সোমবার (৪ মার্চ) নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে সমন্বয় কমিটি গঠন করে সরকার। সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। সমন্বয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে কাজ করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মহাপরিচালক।
এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (মাধ্যমিক-১), কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (কারিগরি অধিশাখা-২), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বিদ্যালয়), আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক), এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মোখলেস উর রহমান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোহসীন উদ্দিন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (সরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা)।
সমন্বয় কমিটির কার্য পরিধি
এই কমিটির কার্য পরিধি হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সুপারিশ ও মতামত দেওয়া, পাবলিক পরীক্ষাসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করতে সুপারিশ দেওয়া, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা।