প্রতিদিনের ডেস্ক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না জামায়াতের। সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকলেও দুই দল হেঁটেছে দুই পথে। আন্দোলনের মাঠে জামায়াত মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেও বিএনপি সব সময়ই ছিল চাপে। নানাবিধ কারণে বিএনপির সন্দেহ, জামায়াত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে সখ্য বজায় রেখে রাজনীতি করছে। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেছে জামায়াত।
সূত্রমতে, বিএনপি-জামায়াত মিত্রতায় স্পষ্ট চিড় ধরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি এবং কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হলেও বিএনপি তখন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। যদিও গত বছরের ১৪ আগস্ট আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপি দলীয়ভাবে শোক জানায়। কিন্তু সেই শোকবার্তায় সাঈদীর রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়। জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট জোট গঠন করে সেখানে জামায়াতকে রাখা হয়নি। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা ভেঙে দিয়ে সমমনা মিত্র দলগুলো নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলন ও এর কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা বিএনপি না করায় ক্ষুব্ধ জামায়াত। এ পরিস্থিতিতে যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকে কর্মসূচিতে থাকলেও দলের আমিরকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিএনপি বিবৃতি না দেওয়ায় জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে যায়। সেই থেকে দল দুটি একই অবস্থানে রয়েছে। এই পরিস্থিতি দূরত্ব বা কৌশলী সম্পর্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জামায়াতের প্রতি বিএনপির সন্দেহ
দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় পর গত বছরের ১০ জুন ঢাকায় সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি পায় জামায়াত। এরপর থেকে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। এমনকি গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় যুগপৎ আন্দোলনে পুলিশ বিএনপির নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ড করলেও পাশে আরামবাগ এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করে জামায়াত।
বিএনপির প্রতি জামায়াতের সন্দেহ
জামায়াত মনে করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভারতের বেশ প্রভাব রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি মনে করছে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প নেই। ভারতবিরোধী রাজনীতি দিয়ে বিএনপি বারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলেও তারা এখন ভারতের অনুকম্পা নিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইছে। বিগত দেড় দশকে বিএনপির সরকার পতনের মতো আন্দোলনমুখী সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপির সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। মাঠের বাস্তবতা অস্বীকার করে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট গঠনের প্রেক্ষাপট
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল বিএনপি। এরপর থেকে দল দুটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে হতে ’৯৯ সালের শুরুতে এসে আনুষ্ঠানিক জোটে রূপ নেয়। তখন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। এই জোটই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পান জামায়াতের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ। তারা দুজনই পরবর্তীসময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। এদিকে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটও পরে বিশ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নিয়ে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মতো করে আছি, বিএনপি বিএনপির মতো করে আছে। জামায়াত গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে, বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে আবার এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জামায়াতের পক্ষ থেকে যা করণীয় তা করা হচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য তৈরি হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য হলে আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে পালিয়ে বেড়াতে হতো না, আমাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হতো না। আমিরে জামায়াতসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে থাকতেন না। সারাদেশে দলীয় অফিস বন্ধ থাকতো না, ব্রিগেডিয়ার আজমী, ব্যারিস্টার আরমানরা গুম থাকতো না। আমাদের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দখল হয়ে গেছে। সুতরাং, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের সখ্যের কথা বলা এটা একটা প্রোপাগান্ডা।’
বিএনপির সঙ্গে সখ্য ভবিষ্যতে বাড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার বলেন, ‘বিএনপির জায়গা থেকে বিএনপি বলতে পারবে। তবে আমরা ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে মাঠে আছি। সেখানে যারাই আসবে তাদের সঙ্গেই আমাদের সখ্য থাকবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে কোনো দূরত্ব নেই বিএনপির, কৌশলগত কারণেই আলাদা মঞ্চে আন্দোলন করে আসছে তারা। ’৭১ এর পর যাদের জন্ম, তারা খাঁটি বাংলাদেশি। তারা তো দেশের বিরুদ্ধে কিছু করছে না। তাদের চাপে রেখে সরকার রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব বাড়লো কি না আওয়ামী লীগ ভালো বলতে পারবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি জামায়াতের ছিল, তা হাইজ্যাক করে অতীতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে জামায়াতের সখ্য।’
এদিকে জামায়াতের মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াত জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করে, বিএনপি বিএনপির রাজনীতি করে, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতি করে।’
বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সম্ভাবনা আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবারই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। রাজনীতিতে সখ্য-ঘনিষ্ঠতা বিষয় নয়।’