প্রতিদিনের ডেস্ক
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি ২৩ নাবিকের জন্য উৎকণ্ঠিত সারাদেশ। দেশ-বিদেশের বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ানো দেশের এ সাহসী সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা ছবি-ভিডিও দেখে কাঁদছেন স্বজনরা, কাঁদছে দেশবাসী। জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে বন্ধুদের অনেকে তাদের সঙ্গে কাটানো নানান সুখস্মৃতির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। স্বজনরা কাঁদছেন বাড়িতে থাকা ছবি বুকে নিয়ে।
জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিক উল্লাহ খান। চট্টগ্রামের চন্দনাইশের ছেলে আতিক পরিবার নিয়ে থাকতেন নগরের নন্দনকানন এলাকায়। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক ছেড়ে আসার আগে গত ৪ মার্চ তিনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি ভিডিও শেয়ার করে লেখেন, ‘একটু ভাব নিলাম আর কি’।
মোজাম্বিকের উপকূলে হাঁটতে থাকা ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন বাজছিল হৃদয়পোড়া গান ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া। মরি আমি ধরফরাইয়া রে…’। ভিডিও লিংক
এর আগে ৩ মার্চ আতিক লেখেন, ‘সমুদ্রে এক ধরনের মায়া আছে। জীবনের অনেকগুলো বছর সমুদ্রে কাটিয়েছি, তারপরও সুযোগ পেলেই চলে আসি সমুদ্র দেখতে। কিনারা থেকে সমুদ্র কেমন, দেখতে চলে আসি।’
তবে নাবিক যেখানেই থাকুন, জাহাজের জীবন যতই উপভোগ্য হোক, তার মন বাঁধা থাকে বাড়ির দুয়ারে, দেশের মাটিতে।
তাইতো জাহাজের প্রকৌশলী ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে এয়ারপোর্টে তোলা ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে লেখেন, ‘ভালো থেকো প্রিয় মাতৃভূমি…। নাবিক তার গন্তব্যে ছুটে চলা আবার শুরু।’
সর্বশেষ মোজাম্বিক ছেড়ে আসার আগে ১ মার্চ সহকর্মীদের সঙ্গে তোলা ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘নাবিক-এর সুখ যেথায়…’
ইব্রাহীম খলিলের ভাতিজা ফয়সাল বলেন, আমার চাচার এবার দেশে কোরবানি করার কথা ছিল। আমার সিনিয়র, তারপরও বন্ধুর মতো মিশতাম। যেদিন জিম্মি হয়েছে তার আগের রাতেও কথা হয়েছে, আমরা দিনের বেশিরভাগ সময় কথা বলতাম, নানান ধরনের মজা করতাম।’
দেশের এ বীর সন্তানরা শুধু যে জাহাজ পরিচালনা করেন তা নয়। সাতসমুদ্র তেরনদীর ওপারেও মাতেন ক্রিকেট নিয়ে। চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খানের শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, এমভি আবদুল্লাহর বাল্কের ভেতরেই ক্রিকেটে মেতে উঠেছেন নাবিকরা।
আতিক লেখেন, ‘প্রতি বলে ছক্কা হয়না রে…। আউট না হলে সেটা বোঝাই যায় না। মিড ওশান ক্রিকেট। থ্যাংকস টু দ্য টিম।’
এসময় তিনি এই ইভেন্ট আয়োজনের জন্য সহকর্মী ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ ও সাইদুজ্জামান সাইদকে ধন্যবাদ জানান। ভিডিও লিংক
আরেক ভিডিওতে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের ২০২৪ সালকে স্বাগত জানিয়ে থার্টি ফাস্ট নাইট পালন করতে দেখা যায়। এসময় সবাইকে বেশ উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল। কিন্তু কে জানতো, এ বছরেই তাদের জীবনে নেমে আসবে ভয়াল কিছু দিন রাত? হয়তো সেটাই আঁচ করতে পেরে জাহাজের আরেক নাবিক আয়ুব খান জাহাজে গোধুলীবেলার ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘Hide your sadness, No one cares’.
২০২৩ সালের ২ মে ছিল জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খানের জন্য অনেক বেশি পাওয়ার। নিজের জন্মদিনে তার জন্য ছিল আরও কিছু সুসংবাদ।
জিম্মি নাবিকদের স্মৃতি কাঁদাচ্ছে স্বজনদের
সেসবের জন্য শুভেচ্ছা জানানোয় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আতিক উল্লাহ খান লেখেন, গতকাল আমার জন্মদিনে অনেকেই শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানিয়ে আমাকে আপনাদের ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন। আজকে আমার বড় মেয়ে ইয়াশরাহ ফাতিমার জন্মদিন। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের জন্মদিনের সবচেয়ে বড় গিফট হিসেবে আল্লাহর রহমতে, আমি সর্বোচ্চ প্রফেশনাল পরীক্ষায় (ডেক অফিসার ক্লাস-১) উত্তীর্ণ হয়েছি, অর্থাৎ ক্যাপ্টেন হিসেবে জাহাজে কমান্ড দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। আলহামদুলিল্লাহ…’
নাবিকদের এসব সুখ, দুঃখ আর বিরহের স্মৃতি পোড়াচ্ছে তাদের পরিবার, স্বজন ও বন্ধুদের। জাহাজে জলদস্যুদের হামলার খবর পাওয়ার পর থেকে উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন আতিকুল্লাহ খানের পরিবার। এরপর থেকেই ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তার মা। ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ছবিটা বুকে জড়িয়ে আছে মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা, উনাইজা মেহবিন এবং ছোট মেয়ে খাদিজা আরুবিয়া।
আরেক নাবিক আনোয়ারুল হক ক্রিকেটের পাগল। তার ওয়ালজুড়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের খেলার খবর। কখনো বাংলাদেশের বিজয়ে উল্লাস করতে দেখা গেছে। আবার কখনো মন খারাপের কথা জানাতে।
জিম্মি নাবিকদের স্মৃতি কাঁদাচ্ছে স্বজনদের
জীবনকে নিয়ে লিখেছেন, ‘সমালোচনাকে জীবনের বাইরে রাখতে আর সবার কাছ থেকে শুধু মধুময় কথা শুনতে চাইলে, নিজের কানে মধু ঢেলে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।’
আনোয়ারের জিম্মি হওয়ার খবর জানিয়ে তার বন্ধু শাহেদুর রহমান বিজয় লিখেছেন, ‘২৩ জন বাংলাদেশি নাবিকসহ মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছে। বন্ধু আনোয়ারুল হক রাজু ওই জাহাজেই আছে। সবাই দোয়া করবেন যাতে জাহাজের সব নাবিককে আল্লাহপাক সহি-সালামতে রাখে এবং সুস্থতার সহিত আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন।
জিম্মি নাবিকদের স্মৃতি কাঁদাচ্ছে স্বজনদের
দরিদ্র পরিবারের সন্তান এমভি আবদুল্লাহর প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন। ধরেছিলেন পরিবারের হাল। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার খবরে তার পরিবারে নেমে এসেছে অমানিষা। সেই স্মৃতি স্মরণ করে তার মা লুৎফুন্নাহার বলেন, আমার ছেলে তার বাবার সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে মাটি কাটার কাজ করতো। অনেক কষ্টে পড়ালেখা করিয়েছি। এক বছর আগে বিয়ে করিয়েছি। তার বউয়ের বাচ্চা হবে। আমার এখন কী হবে?
সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ফায়ার ফাইটার মো. সালেহ আহমদ। তার অপহরণের খবরে কান্না থামছে না তার তিন মেয়ের। অপহরণের খবরে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরা এসেছিলেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার সিংবাহুড়া গ্রামের বাড়িতে।
এভাবেই এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি ২৩ নাবিকের পরিবারগুলোর কান্না থামছে না। প্রতিনিয়ত তারা জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং এবং নাবিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। পরিস্থিতির আপডেট জানতে যোগাযোগ করছেন সংবাদকর্মীদের সঙ্গেও। সে সময় তারা করছেন নিজ ছেলে, স্বামী বা বাবার স্মরণ। তাদের দাবি শুধু একটাই, ‘কলিজার টুকরোটা ফেরত চাই।’