২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘনের তুলনায় অভিযোগ নগণ্য

প্রতিদিনের ডেস্ক
পণ্য কিনতে কিংবা সেবা পেতে গিয়ে প্রতারিত হলে ভোক্তাদেরও আছে প্রতিকার চাওয়ার অধিকার। এজন্য আছে সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। দেশের যে কোনো নাগরিক নির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন। তবে প্রতিদিন দেশে যত সংখ্যক মানুষ এ অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন সে তুলনায় অভিযোগ দেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। অনেকে বিষয়টি নিয়ে জানেনই না। আবার কেউ জানলেও কখনো প্রয়োগ করেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে হারে ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সে তুলনায় এখন পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা অনেক কম। আবার অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও আছে ধীরগতি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ব্যাপ্তিও এখন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম। এছাড়া প্রতারণা কমাতে জনসচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে যেসব কাজ ‘ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলো হলো সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত আদায়, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না থাকা, নোংরা পরিবেশে মানহীন ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশন, পণ্যে ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, বেশি দাম নেওয়া, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য, ক্রেতার সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ ও মজুতদারি। দেশে অহরহ এমন ঘটনা ঘটলেও এ আইনের আওতায় অভিযোগ করা হচ্ছে কম।
ভোক্তা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাছ থেকে অভিযোগ এসেছে এক লাখ ২৩ হাজার ৭৫৩টি। অর্থাৎ ১৫ বছরে সারাদেশ থেকে এ সংখ্যা। এর মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার ৩৬০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে।
বাজারে যে অহরহ প্রতারণা হচ্ছে তার একটি প্রমাণ মেলে ২০০৯-১০ থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অধিদপ্তর ৭২ হাজার ৯৩৭টি বাজার তদারকির তথ্য বিশ্লেষণে। কারণ এসব অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার ৯০৮টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিটি অভিযানে দুই বা ততধিক অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। এ সময়ে মোট ১২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে অধিদপ্তর।
এসব বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের ভোক্তারা অধিকার সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নন। এখন যে আইনটা আছে তার ফলে মানুষের সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। তারপরও দেশে যে হারে ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন হয় তার তুলনায় এখন পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা অনেক কম। জনসচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।’
রাজধানীর শাহজাহানপুরের মাংস ব্যবসায়ী খলিল এবারের রমজানে ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছে। কিন্তু খিলগাঁওসহ আশপাশের বাজারগুলোতে মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা। এটা এক ধরনের প্রতারণা বলে মনে করেন একজন সাধারণ ভোক্তা আবু সাইদ। সে বিষয়ে তিনি খিলগাঁও বাজারে উস্মা প্রকাশ করেন প্রতিবেদকের কাছে। তবে তিনি এমন প্রতারণার বিষয়ে কখনো ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করেননি। কারণ তিনি জানেন না অভিযোগের বিষয়টি। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আবার অভিযোগ করা যায় সেটা আমার জানা নেই। অভিযোগ করার উপায় যদি থাকেও তবে প্রতিকার পাব এ বিশ্বাস হয় না।
মিজানুর রহমান মিথুন নামের আরেক ভোক্তা বলেন, এখন থেকে সাত-আট বছর আগের কথা। আমি সয়াবিন তেল কিনেছিলাম রাজধানীর আজিমপুরের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে। আমার কাছ থেকে তেলের ক্যানের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি রাখা হয়েছিল। পরে আমি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর প্রতিকার পাই। আমাদের দেশের এমন একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করার জন্য আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
যেভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হয়
প্রতারিত হলে পণ্য বা সেবা কেনার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। সেটা অবশ্যই হতে হবে লিখিত। ভোক্তা অধিকারে ফ্যাক্স, ইমেইল, ওয়েবসাইট ইত্যাদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে অভিযোগের সঙ্গে পণ্য বা সেবা কেনার রসিদ যুক্ত করতে হবে।
অভিযোগ অনলাইন ও সরাসরি দুভাবেই করা যায়। এর ফরম অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেই আছে। অভিযোগ যথাযথভাবে দায়ের করলে অধিদপ্তর থেকেই শুনানির তারিখ জানানো হয় দুই পক্ষকে। এরপর একজন কর্মকর্তার সামনে শুনানি হয়। এসব বিষয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান।
ভোক্তাদের অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি আরও সহজ করতে গত বছর ‘কনজ্যুমার কমপ্লেন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (সিসিএমএস) বা ‘ভোক্তা অভিযোগ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক ওয়েব পোর্টাল ও সফটওয়্যার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ঘরে বসে আগের চেয়ে দ্রুত অভিযোগ করা যাবে। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ কোন পর্যায়ে আছে, তা যাচাই করে দেখতে পারবেন অভিযোগকারীরা।
শাস্তির বিধান
আইনটিতে কোনো সেবাদানকারীর অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতায় সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটলে অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ডেরও শাস্তি রাখা হয়েছে। এছাড়া দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান আছে। ফৌজদারি ব্যবস্থায় (ধারা-৫৭) মামলার মাধ্যমে অপরাধীর সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এতে শাস্তির ব্যাপ্তি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে দণ্ড ও জরিমানা বাড়ানো ছাড়াও ই-কমার্সকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। পুরোনো আইনটি যুগোপযোগী করা হচ্ছে। আগের চেয়ে আমাদের কার্যক্রম অনেক গতিশীল হয়েছে। আমরা অভিযোগের অনেকটা নিষ্পত্তি করছি। অনেক সম অভিযোগকারীরা ডকুমেন্ট (প্রয়োজনীয় কাগজপত্র) দেন না। এ কারণে তা নিষ্পত্তি করাও সম্ভব হয় না।’
এদিকে ভোক্তাদেরও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে বলে মত দেন সফিকুজ্জামান। প্রতারিত হলে অবশ্যই অভিযোগ করতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের আন্তরিক সহযোগিতা আশা করেন তিনি।
দেশে ভোক্তা পরিস্থিতির এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার (১৫ মার্চ) ‘বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস’ পালিত হচ্ছে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনে নানান আয়োজন করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি, ভোক্তার স্বার্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি’।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়