শঙ্কাতো আছেই তবুও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারছে সুন্দরবনের মৌয়ালরা

0
4

উৎপল মণ্ডল,শ্যামনগর
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপকূলীয় অঞ্চলের ১ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম। তাই আগে-ভাগেই নৌকা সাজানোর কাজ শেষ করেছেন সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মৌয়ালরা। উপকূলীয় বনবেষ্ঠিত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন ও কদমতলা স্টেশন এলাকার প্রায় দুই হাজার মৌয়ালী সুন্দরবনের মধু আহরণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মৌয়ালরা। আগামী সোমবার থেকে দুই মাসের জন্য তাঁরা জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে মধু আহরণের সুযোগ পাচ্ছেন। এজন্য সুন্দরবন এলাকার মৌয়ালরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বনে যাওয়ার জন্য নৌকা মেরামত ও রঙের কাজসহ শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। এরপর শুধু বন বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী, নীলডুমুর, দাতিনাখালি, মুন্সিগঞ্জ, গাবুরা, কদমতলা এলাকা ঘুরে মৌয়ালদের সাথে কথা বলে সুন্দরবনে যাওয়ার শেষ সময়ের প্রস্তুতি সারলেও আশানুরূপ মধু পাওয়া নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন ওইসব এলাকার মৌয়ালেরা। তবে অভিযোগ আছে মৌসুম শুরুর আগেই সুন্দরবনে মধুচোর চক্র প্রবেশ করে আগাম চাক কাটা ও বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে অন্য মৌসুমের চেয়ে মধু অনেক কম পাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের মৌয়ালদের মধ্যে। উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী এলাকার সিরাজুল ইসলাম৫৫ বছর। সুন্দরবন থেকে তিনি মধু আহরণ করছেন ২৫-২৬ বছর। তিনি জানান, এ বছর মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে প্রচুর বনজীবী সুন্দরবনে থেকে আগেভাগে চোরাইভাবে মধু কেটেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার মধু অনেক কম পাওয়া যেতে পারে। নীলডুমুর খেয়া ঘাটে কথা হয় নৌকার মালিক বুড়িগোয়ালিনীর দাতিনাখালী এলাকার মৌয়াল আব্দুল হক এর সাথে তিনি জানান, ১ এপ্রিল তারা পাস নিয়ে বনে যাবেন। এরই মধ্যে নৌকা মেরামতসহ সকল প্রস্তুতি সেরেছেন তিনি। তার নৌকায় আট জন সহযোগী রয়েছেন। এক মৌসুমে মধু আহরণ করতে গিয়ে একেকজন মৌয়ালের খরচ হয় ১২ থকে ১৫ হাজার টাকা। তবে বন থেকে মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে চুরি করে আগাম চাক থেকে মধু কেটেছে মধুচোর চক্র। অন্যদিকে এবার বৃষ্টি নেই। তাই মধু কেমন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ বনে ফুলের সমারোহ বেশি থাকলেও বৃষ্টি না হওয়ায় তা ঝরে যাচ্ছে। আর ফুল টিকে না থাকলে মধুও কম হয় বলে তিনি জানান। গাবুরার মৌয়াল রফিকুল সরদার বলেন, আমি মহাজনের থেকে টাকা নিয়ে আটজনের একটি বহর নিয়ে বনে যাচ্ছি। বেশি মধু না পেলে চালান মার যাবে। তখন ঋণের বোঝা টেনে বেড়াতি হবে। এলাকায় কাজ-কাম না থাকায় বাধ্য হয়ে এ বছর মধু সংগ্রহে যাচ্ছিএছাড়াও মৌয়ালদের অভিযোগ, আগে বন বিভাগ তিন মাস (এপ্রিল, মে ও জুন) মধু আহরণের অনুমতি দিত। কিন্তু গত দুই বছর শুধু এপ্রিল ও মে মাসে মধু আহরণ করতে দিচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের প্রায় অর্ধেক এলাকায় মধু আহরণের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। এ কারণে আগের চেয়ে মধু আহরণের পরিমাণ কমে গেছে। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে ৪১১টি পাস নিয়ে ২ হাজার ৮৯৮ জন মৌয়ালরা ১ হাজার ৪৪৯ কুইন্টাল মধু এবং ৩৩৪ দশমিক ৭০ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০০ টাকা। ২০২৩ সালের মধু ও মোম আহরণের জন্য ৩৬৫টি অনুমতিপত্র (পাস) দেওয়া হয়। এসব অনুমতিপত্রের বিপরীতে ২ হাজার ৪৫০ জন মৌয়াল সুন্দরবনে যান। তাঁরা ১ হাজার ২২৫ কুইন্টাল মধু ও ৩৬৭ দশমিক পাঁচ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। আর এ থেকে ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা সরকারের রাজস্ব আসে। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস (অনুমতি) নিয়ে জেলেদের ছদ্মবেশে মধুচোর চক্র প্রবেশ করছে। মৌসুমের আগেই বনে ঢুকে চুরি করে তারা ৪০-৫০ ভাগ মধু আহরণ করে ফেলছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা চুরি করে মধু সংগ্রহ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে স্বীকারও করেছেন। লোকবল সংকটের কারণে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় মধু চুরি ঠেকাতে পারছেন না বলে দাবি তাঁদের।জানতে চাইলে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা নূরুল আলম বলেন, ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণ শুরু হয়। কিন্তু তার আগেই চুরি করে একাধিক চক্র মধু আহরণ করছে। চুরি বন্ধ করতে হলে মধু আহরণের দুই মাস সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস (অনুমতি) বন্ধ রাখতে হবে। নূরুল আলম আরও জানান, যে চাকে কমপক্ষে পাঁচ কেজি মধু পাওয়া যেত, এপ্রিলের আগে মধু আহরণ করলে ওই চাকে ৫০০ গ্রামের বেশি মধু পাওয়া যায় না। সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে এপ্রিল-মে মাসে যে পরিমাণ মধু আহরণ হয়, চুরি করে আগেই তার ৪০-৫০ ভাগ মধু আহরণ করছে এসব চক্র। লোকবলসংকটের কারণে চুরি ঠেকাতে পারছেন না বলে এই কর্মকর্তা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি আরও জানান, প্রতিটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১০ জন মৌয়ালি অবস্থান করতে পারবেন। একজন মৌয়ালি ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ কেজি মধু ও ১৫ কেজি মোম আহরণ করতে পারবেন। ১৫ দিনের বেশি কোনো মৌয়ালি সুন্দরবনে অবস্থান করতে পারবেন না। এ বছর ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম পাওয়ার আশা কর‌ছে বন বিভাগ।